স্বপ্ন আমাদের মনের একটি রহস্যময় জগৎ, যেখানে আমরা প্রায়ই আমাদের প্রিয়জনদের, বিশেষ করে রোমান্টিক সঙ্গীর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সম্মুখীন হই। কিন্তু যখন এই স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়, তখন তা আমাদের সম্পর্কের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, সঙ্গীর সম্পর্কে ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব বা বিশ্বাসঘাতকতার স্বপ্ন পরবর্তী দিনের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সাইকোলজি টুডের এক প্রতিবেদনে এই বিষয়ে গবেষণার ফলাফল এবং কীভাবে এই দুঃস্বপ্নের সাথে মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করব।
স্বপ্ন কেন গুরুত্বপূর্ণ:
স্বপ্নে আমরা প্রায়ই সামাজিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, যেখানে পরিবার, বন্ধু এবং বিশেষ করে আমাদের সঙ্গী উপস্থিত থাকেন। কিছু স্বপ্ন গবেষক মনে করেন, সঙ্গীর সম্পর্কে স্বপ্ন বাস্তব জীবনের সম্পর্কের একটি সিমুলেশন হিসেবে কাজ করে। এই স্বপ্নগুলো আমাদের ঘুমের সময় সম্পর্কগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
গবেষণার বিবরণ:
‘দ্য জার্নাল অফ সোশ্যাল সাইকোলজিকাল অ্যান্ড পার্সোনালিটি সায়েন্স’-এ প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সঙ্গীর সম্পর্কে স্বপ্ন পরবর্তী দিনের মিথস্ক্রিয়াকে কীভাবে প্রভাবিত করে। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। এই গবেষণায় ৬১ জন স্নাতক শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন, যারা কমপক্ষে ছয় মাস ধরে কোনো সম্পর্কে ছিলেন।
অংশগ্রহণকারীদের ১৪ দিন ধরে দুটি রেকর্ড রাখতে বলা হয়েছিল:
দৈনিক স্বপ্নের ডায়েরি:
ঘুম থেকে ওঠার পরপরই তারা তাদের স্বপ্নের বিস্তারিত বিবরণ লিখতেন। এতে স্বপ্নে উপস্থিত চরিত্র, চিন্তা এবং আবেগের বিবরণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা স্বপ্নে অনুভূত নেতিবাচক আবেগ যেমন, রাগ, উদ্বেগ, চাপ, হতাশা, দুঃখ। এবং ইতিবাচক আবেগ যেমন, আনন্দ, স্নেহ, প্রেম, শান্তি), ঈর্ষা (ঈর্ষা বা বিশ্বাসঘাতকতা এছাড়াও অপরাধবোধ বা বিব্রতকর অবস্থা নোট করতেন।
প্রতিদিনের মিথস্ক্রিয়ার রেকর্ড: দিনের শেষে তারা সঙ্গীর সাথে তাদের ভালোবাসা/ঘনিষ্ঠতা, সাধারণ মিথস্ক্রিয়া এবং দ্বন্দ্বের বিষয়ে রিপোর্ট করতেন।
গবেষকরা মোট ৮৪২টি স্বপ্ন সংগ্রহ করেছেন, যার মধ্যে ৫৩ জন অংশগ্রহণকারী তাদের সঙ্গীর সম্পর্কে অন্তত একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। তারা স্বপ্নে সঙ্গীর উপস্থিতি, তর্ক, দ্বন্দ্ব বা বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়বস্তু চিহ্নিত করেছিলেন।
অংশগ্রহণকারীরা স্বপ্নে সঙ্গীর উপস্থিতি, তর্ক, দ্বন্দ্ব বা বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়বস্তু চিহ্নিত করেছিলেন।
গবেষণার ফলাফল: সঙ্গীর সম্পর্কে স্বপ্ন দেখা সাধারণত পরের দিন তাদের সঙ্গে বেশি মিথস্ক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত। তবে, দুটি স্বপ্নের উপাদান পরের দিন দ্বন্দ্বের পূর্বাভাস দিয়েছে:
ঈর্ষাপূর্ণ স্বপ্ন: স্বপ্নে ঈর্ষা বা বিশ্বাসঘাতকতার আবেগ পরের দিন সঙ্গীর সাথে দ্বন্দ্ব বাড়িয়েছে। দ্বন্দ্বপূর্ণ স্বপ্ন: স্বপ্নে সঙ্গীর সাথে তর্ক বা দ্বন্দ্ব দেখা গেলে পরের দিন বাস্তবেও দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা বেড়েছে। এছাড়াও সঙ্গীর অবিশ্বস্ততার স্বপ্ন দেখলে পরের দিন সঙ্গীর প্রতি ভালোবাসা বা ঘনিষ্ঠতা কমে যায়।
গুরুত্বপূর্ণভাবে, এই সম্পর্কগুলো একমুখী ছিল। অর্থাৎ, স্বপ্নের আবেগ পরের দিনের মিথস্ক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে, কিন্তু দিনের ঘটনাগুলো স্বপ্নকে প্রভাবিত করেনি। এছাড়া, সাধারণ আবেগ যেমন স্বপ্নে দুঃখ, পরের দিনের মিথস্ক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত ছিল না।
কেন এমন হয়:
সঙ্গীর অবিশ্বস্ততা বা দ্বন্দ্বের স্বপ্ন দেখলে এই নেতিবাচক আবেগগুলো ঘুম থেকে ওঠার পরেও আমাদের মনে থেকে যায়। এই আবেগগুলো সারাদিন আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে, যা সম্পর্কে তর্ক বা দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি স্বপ্নে দেখেন যে আপনার সঙ্গী আপনাকে প্রতারণা করেছে, তবে এই ঈর্ষা বা অবিশ্বাসের অনুভূতি আপনার দিনের আচরণে প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি যদি স্বপ্নটি বাস্তব না হয়।
গবেষকরা মনে করেন, এই ধরনের স্বপ্ন প্রায়ই আমাদের অবচেতন মনের ভয় বা নিরাপত্তাহীনতার প্রতিফলন। যদি আপনি আপনার সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ বা ভয় অনুভব করেন, তবে এই ভয়গুলো স্বপ্নে প্রকাশ পেতে পারে। তবে, এটা মনে রাখা জরুরি যে স্বপ্নে যা দেখা যায়, তা বাস্তব নয়। আপনার সঙ্গী স্বপ্নে প্রতারণা করলেও, এর মানে এই নয় যে তারা বাস্তবে তা করেছে। এটি কেবল আপনার নিজের উদ্বেগ বা নিরাপত্তাহীনতার প্রকাশ।
কীভাবে মোকাবিলা করবেন: সঙ্গীর সম্পর্কে নেতিবাচক স্বপ্ন দেখলে তা সম্পর্কের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে, তবে এই প্রভাব কমানোর উপায় রয়েছে। এখানে কিছু পরামর্শ দেয়া হলো:
স্বপ্নের আবেগকে চিহ্নিত করা:
ঘুম থেকে ওঠার পর যদি আপনি ঈর্ষা বা রাগ অনুভব করেন, তবে মনে রাখবেন যে এই আবেগগুলো স্বপ্ন থেকে এসেছে, আপনার সঙ্গীর আচরণ থেকে নয়। এটি আপনাকে অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব এড়াতে সাহায্য করবে।
সঙ্গীর সঙ্গে আলোচনা:
আপনার স্বপ্ন এবং এর সাথে জড়িত আবেগ নিয়ে সঙ্গীর সাথে কথা বলুন। এটি আপনার নিরাপত্তাহীনতা বা উদ্বেগ দূর করতে সাহায্য করবে এবং সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।
নিজের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে বুঝতে চেষ্টা করা: যদি আপনি বারবার এই ধরনের স্বপ্ন দেখেন, তবে এটি আপনার সম্পর্কে কোনো গভীর উদ্বেগের ইঙ্গিত হতে পারে। এই উদ্বেগগুলো চিহ্নিত করুন এবং সেগুলো সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিন।
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলুন:
সম্পর্কে ইতিবাচক মুহূর্তগুলোর উপর ফোকাস করুন। এটি আপনার মনে ইতিবাচক আবেগ জাগিয়ে তুলবে, যা স্বপ্নেও প্রতিফলিত হতে পারে।
সঙ্গীর সম্পর্কে দুঃস্বপ্ন দেখা অপ্রীতিকর হতে পারে, তবে এটি আপনার সম্পর্কের জন্য হুমকি নয়। স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটির গবেষণা এবং দ্য জার্নাল অফ সোশ্যাল সাইকোলজিকাল অ্যান্ড পার্সোনালিটি সায়েন্স-এর গবেষণার পর মনোবিদরা বলছেন, এই স্বপ্নগুলো অবচেতন মনের ভয় বা উদ্বেগের প্রকাশ মাত্র। স্বপ্নের আবেগকে বাস্তব জীবন থেকে আলাদা করতে শিখুন এবং সঙ্গীর সাথে খোলামেলা যোগাযোগ বজায় রাখুন। এইভাবে, আপনি নেতিবাচক স্বপ্নের প্রভাব কমাতে পারবেন এবং সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ ও ইতিবাচক করে তুলতে পারবেন।