ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দিনভর বৈঠক, তিন দাবিতে অনড় এনসিপি

স্কাই নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট সময় রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দিনভর বৈঠকে অংশ নেয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বৈঠকে এনসিপি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, তারা তিনটি বিষয়ে কোনো ছাড় দেবে না। এসব দাবি হলো—রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, সংবিধান পুনর্লিখন (রি-রাইট) এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নিশ্চয়তা।

এর আগে, শনিবার (১৯ এপ্রিল) সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এই আলোচনা শুরু হয়। দিনভর চলা বৈঠকে এনসিপির পক্ষ থেকে ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল বৈঠকে উপস্থিত হয়।

বৈঠক শেষে নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, এনসিপি চায় সংবিধান সংস্কারের জন্য গণভোট আয়োজন করা হোক। তারা প্রধানমন্ত্রী-নির্ভর নয়, বরং মন্ত্রিসভা-ভিত্তিক শাসন কাঠামো চায়। তিনি বলেন, জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, সেই প্রত্যাশা পূরণ করাই এখন সময়ের দাবি।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই ১০০টি আসনে নারীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হোক। সংবিধানে এমন নিয়ম করা হোক যাতে কেউ দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন। একজন ব্যক্তি যদি একবার প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে তিনি আর রাষ্ট্রপতি হতে না পারেন। সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার দায়িত্ব থাকবে একটি সাংবিধানিক কাউন্সিলের ওপর।’

নাহিদ ইসলাম বলেন, বর্তমান সংবিধানে দলীয় আদর্শ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি মনে করেন, ’৭২ সালের মূলনীতি এবং পরে যুক্ত হওয়া দলীয় মূলনীতি বাতিল করা উচিত।’

তিনি জানান, ‘২০২৪ সালের জুলাই মাসে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, সেটি কেবল একটি ব্যক্তির পতনের জন্য নয়। সেই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো বদলানো এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। সেই ধারাবাহিকতায় এনসিপির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এবং তারা রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন একটি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জনগণ চায়, একটি ফ্যাসিবাদমুক্ত রাষ্ট্র, যেখানে মানুষের অধিকার নিশ্চিত থাকবে। তাই সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা এবং সরকারের কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে।’

দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, কোনো নির্বাচন আয়োজনের আগে বিচার এবং সংস্কার প্রক্রিয়াকে দৃশ্যমান করতে হবে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন অবশ্যই দরকার। তবে তার আগে জনগণকে বোঝাতে হবে, সত্যিই আমরা সংস্কারের পথে যাচ্ছি। সরকার সময় চাইতে পারে, তবে সেই সময় যেন শুধু ক্ষমতায় থাকার অজুহাত না হয়।’

তিনি আরও বলেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে এক ব্যক্তির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে। এজন্য সংবিধানের মৌলিক সংস্কার দরকার।

দলের দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তারা চাইছেন একটি মাত্র নির্বাচন, যা হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে সেই নির্বাচনকেই গণপরিষদের মর্যাদা দিতে হবে। কারণ সংবিধানের রি-রাইট বা মৌলিক সংশোধন কেবল গণপরিষদই করতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হোক। অতীতে আমরা দেখেছি, ক্ষমতা পরিবর্তনের সময় বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা এমনকি রক্তপাত হয়েছে। আমরা চাই না, সেই ইতিহাস আবার ফিরে আসুক।’

তিনি বলেন, সংসদের কার্যকারিতা বাড়াতে এবং সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

এ সময় তিনি জানান, এনসিপি নাগরিকদের অধিকার রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাসনাত বলেন, বিএনপির সঙ্গে কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে ঠিকই, তবে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব।

বৈঠকের শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। সেই বাস্তবতা থেকেই রাষ্ট্র সংস্কারের আলোচনা চলছে।

তিনি বলেন, ‘আপনারা সাহসিকতার সঙ্গে আন্দোলন করেছেন, পরিবর্তন এনেছেন। এখন সময় এসেছে সেই পরিবর্তনকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার। আমরা চাই, জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি জাতীয় সনদ তৈরি হোক।’

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে যেন আর ফ্যাসিবাদী শাসন ফিরে না আসে, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হোক এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই হোক—এটাই এখন সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত।

বৈঠকে কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন—ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফররাজ হোসেন ও মনির হায়দার।

এদিকে এনসিপির পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, সারোয়ার তুষার, মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সরওয়ার চৌধুরী।

এনসিপি জানিয়েছে, তারা খুব পরিষ্কারভাবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে এগোচ্ছে। এজন্য দরকার রাষ্ট্রের গঠনমূলক সংস্কার। দলীয়করণ থেকে মুক্ত করে, সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল রূপ দিতে চায় তারা।

দলটি মনে করে, অতীতে নানা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি। এবার সেই ব্যর্থতা কাটিয়ে একটি কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন প্রয়োজন সঠিক সিদ্ধান্ত ও ঐকমত্য।

এই পোস্ট টি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2021 Skynews24.net
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com