ঢাকা : লেয়ার মুরগির খামারটি যেদিন স্থাপন করা হয়, ৯৫ ভাগ মুরগি ডিম দেয়া শুরু করেছে সেদিন থেকেই। ১৮ হাজার ৩৩৭টি মুরগির বাচ্চা ৩৬৫ দিনে ডিম দিয়েছে ৬৬ লাখ ৯৩ হাজার ৫৬টি। শ্বেতবিপ্লবের দুনিয়ায় ঘটনাটি অবিশ্বাস্য হলেও এমনটিই ঘটেছে মো. আবু সাঈদের মালিকানাধীন ‘তানভীর পোল্ট্রি’তে।
খুলনার রূপসা উপজেলার মোছাব্বারপুর, পশ্চিমপাড়া শীরগাতি, মধ্যপাড়া ডোমরা, পশ্চিম নন্দনপুর, পূর্বপাড়া খান মোহাম্মদপুর, পশ্চিম নন্দনপুর এবং আইচগাতি গ্রামে ‘তানভীর পোল্ট্রি’র খামারগুলো অবস্থিত। অত্যাশ্চর্য মুরগির এই খামার স্থাপিত হয় ২০১৫ সালের ১ জুলাই। কিন্তু নিবন্ধন হয় তারও একবছর আগে। অর্থাৎ জন্মের আগেই নিবন্ধন। অবিশ্বাস্য, অদ্ভুত এবং অত্যাশ্চার্য এই পোল্ট্রি ফার্মের তথ্যে পেশাদার খামারিরা হয়তো ভিড়মি খাবেন। কিন্তু মো. আবু সাঈদের এই পোল্ট্রি খামারে মোটেই বিস্মিত হয়নি আয়কর বিভাগ। গড়বড়ে এই হিসেব বরং বিমুগ্ধই হয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তা। তাই ৫৭ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে ‘দায়মুক্তি’র সুপারিশ করেছেন এই কর্মকর্তা।
‘বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশন’ সূত্র জানিয়েছে, উন্নতজাতের একটি লেয়ার মুরগি ১৮ থেকে ১৯ সপ্তাহ বয়সে ডিম দিতে শুরু করে। ৭২ থেকে ৭৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত এরা ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার সময় মুরগিগুলো গড়ে সোয়া ২ কেজি খাবার খায় ডিম উৎপাদন করে এক কেজি পরিমাণ। এ হিসেবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিভিন্ন সংগঠনের অধীন একাধিক খামারি। তাদের মতে এটি অবিশ্বাস্য, অবাস্তব এবং গাঁজাখুরি গল্প। কিন্তু শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক নোট-গাইড বিক্রেতা মো. আবু সাইদ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে এমনটিই দাবি করেছেন আয়কর নথির তথ্যযুক্ত করে ২০১৭ সালে দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন তিনি।
ওই বিবরণীতে আবু সাঈদ অন্তত : ৩২ কোটি টাকা আয়ের উৎস দেখিয়েছেন হাঁস-মুরগি এবং মৎস্য প্রতিপালনলব্ধ। এর সপক্ষে তিনি রেকর্ডপত্রও দাখিল করেছেন। দাবি করেছেন, ‘তানভির পোল্ট্রি’ এবং ‘তানভির ফিসারিজ’ নামক তার দু’টি খামার রয়েছে। খুলনার রূপসা উপজেলার মোছাব্বরপুর, পশ্চিমপাড়া শীরগাতি, নন্দনপুরসহ কয়েকটি গ্রামে ১২ জনের কাছ থেকে শেড লিজ নিয়ে তিনি ১৫টি শেডে খামার করেছেন। একই উপজেলার জাবুসা মৌজায় সাড়ে ৫শ’ বিঘা জমির ওপর ‘তানভির ফিশারিজ’ করেছেন মর্মে দাবি করেন কাগজপত্রে। তবে সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের রেকর্ডপত্রে দাবিকৃত তথ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি।
হাঁস-মুরগি লালন-পালন ও পোল্ট্রি খামার ভাড়ার চুক্তিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, মো. আবু সাইদের মালিকানাধীন ‘তানভির পোল্ট্রি’ (রেজি: নং-খুল-বিডি-৪৮) রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করেছেন ২০১৪ সালের ১ জুলাই। বাস্তবে খামারটির রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট। প্রশ্ন হচ্ছে, পোল্ট্রি খামারের মালিক হওয়ার একবছর আগে রেজিস্ট্রেশন পেলেন কিভাবে? খামারে ১৮ সপ্তাহের কমবয়সী ডিমপাড়া মুরগির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে লক্ষাধিক। ব্রয়লার মুরগি উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫ হাজার।
আয়কর বিবরণীতে তিনি ডিমপাড়া লেয়ার মুরগি দেখিয়েছেন ১৮,৩৩৭টি। যার সবগুলোই ১৮ সপ্তাহের কমবয়সী মুরগির বাচ্চা। এসব বাচ্চা থেকে বার্ষিক ডিম উৎপাদন দেখিয়েছেন ৬৬ লাখ ৯৩ হাজার ৫টি। অর্থাৎ খামার স্থাপনের দিন থেকেই একদিন বয়সী মুরগির ৯৫ ভাগ বাচ্চা ডিম পাড়তে শুরু করেছে। ভাড়ার চুক্তি অনুযায়ী ১৫টি শেডের মোট আয়তন ২১ হাজার ৯০২ বর্গফুট। কিন্তু আয়কর নথিতে শেডের মোট আয়তন উল্লেখ করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৫২ বর্গফুট। চুক্তি অনুযায়ী শেডের ভাড়া গুনছেন ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা। ২০১৫-২০১৬ করবর্ষের নথিতে আবু সাইদ মুরগির শেড ভাড়া দেখিয়েছেন ৫১ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫৪ টাকা। অথচ ২১,৯০২ বর্গফুট আয়তনের শেড ভাড়ার চুক্তি করা হয়েছে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা। এখানে ৪৩ লাখ ৫৯হাজার ৮৫৪ টাকা গোপন করেন। ২০১৬-২০১৭ করবর্ষে শেড ভাড়ার চুক্তি উল্লেখ করেছেন ১২টি। কিন্তু শেড দেখিয়েছেন ১৭টি। চুক্তিতে ভাড়া ৮,২৬,৮শ’ টাকা দেখালেও দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ৬৭ লাখ ৮৫ হাজার ১৩০ টাকা উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে গোপন করেছেন ৫৯ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩০টাকা।
গোঁজা মিলের মৎস্য খামার : দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে আবু সাইদ ২০১৩ সাল থেকে ২০৭ একর জমিতে মৎস্য চাষ করছেন মর্মে দাবি করেন। এর সপক্ষে তিনি যে সনদ দাখিল করেছেন সেটি ভুয়া। কারণ এতে সমিতির সভাপতির সীর-স্বাক্ষর নেই। দাখিলকৃত বিবরণীতে তিনি খুলনার রূপসা উপজেলার জাবুসা গ্রামে ৫৩১ বিঘা জমিতে মৎস্য চাষ করছেন মর্মে দাবি করেন। নোট-গাইড বিক্রেতা থেকে আকস্মিক ‘মৎস্যজীবী’ হয়ে প্রথম বছরেই তিনি প্রফিট করেন ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে, মাছ বিক্রি করে প্রথম বছরই যদি ৭/৮ কোটি টাকা লাভ হয় তাহলে তিনি কতটা দক্ষ মৎস্যজীবী? তাকে কি পরিমাণ অর্থই বা ঢালতে হয়েছে মাছের পুকুরে? ওই মাছ বিক্রি করলেন কোথায়? মাছের পোনা-খাবার ইত্যাদি কিনলেন কোত্থেকে? সেই টাকার উৎসই বা কি? এমন প্রশ্নের কোনো জবাব তিনি দিতে পারেন নি। মূলত: অবৈধ সম্পদের বৈধতা দিতেই তিনি পোল্ট্রি ও মৎস্য খামারি সাজেন। যে কারণে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে আশ্রয় নিতে হয় জাল-জালিয়াতির। যার প্রমাণ রয়ে গেছে দুদকে দাখিলকৃত প্রতিটি কাগজপত্রে।
সম্পদ বিবরণীতে তিনি দাবি করেন, জাবুসা গ্রামের মৃত আব্দুল মজিদ খানের পুত্র আব্দুল করিম খানের কাছ থেকে ৩৮০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে মৎস্য চাষ করছেন। একই গ্রামের আব্দুর রশিদ সেখ’র পুত্র এসএম আসাফউদ্দৌলার কাছ থেকে লিজ নিয়েছে ১৫১ বিঘা। কিন্তু সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, একই মৌজার একই দাগে এই দুই ব্যক্তির এই পরিমাণ জমির কোনো অস্তিত্ব নেই। দুদকের সম্পদ বিবরণীতে মৎস্য খামারের ভুয়া তথ্য ও রেকর্ডপত্র দাখিল করেছেন। তবে দুদক অনুসন্ধান শুরুর পর তিনি জাবুসা মৌজার ভেতরই দূরবর্তী অন্যত্র কয়েকটি জমিতে ‘তানভীর ফিশারিজ’ নামক সাইনবোর্ড পুঁতে রেখেছেন। যদিও এসব জমিনে মাছ চাষের প্রমাণ মেলে নি।
রেকর্ডপত্রে দেখা যায়,২০১৬-২০১৭ আয়কর বর্ষের চুক্তিপত্রে লিজদাতা আব্দুল করিম খান (প্রথমপক্ষ) এবং তানভির ফিশারিজ (দ্বিতীয়পক্ষ)র মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অথচ চুক্তিপত্রের বর্ণনায় জনৈক সামসুন্নাহারের মালিকানাধীন রেখা ফিসারিজের সঙ্গে
আব্দুল করিম খানের লিজ সম্পাদন করেছেন মর্মে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ একই জমি দুইজনের কাছে লিজ দেখানো হয়েছে।
এতে প্রমানিত হয়। আবু সাঈদ এক্ষেত্রে ভুয়া চুক্তিনামা দাখিল করেছেন। দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে তিনি আসাফউদ্দৌলার
কাছ থেকে ১০৩ একর এবং মোস্তফা কামালের কাছ থেকে ৮৪ একর জমি লিজ করেছেন মর্মে, দাবি করেছেন। কিন্তু ২০১৭-২০১৮ করবর্ষে ৮৪ একর বা ২৫২ বিঘার স্থলে ৩৩৬ বিঘা উল্লেখ করেছেন। চুক্তিনামায় প্রতি বিঘার বার্ষিক ৪০০০ টাকায় চুক্তি সম্পাদিত হলেও আয়কর রির্টানে ৩৫০০ টাকা এবং ২৫২ বিঘার স্থলে ৩৩৬ বিঘা দেখিয়েছেন। কিন্তু আয়কর আদেশে ৫৬১ বিঘার মধ্যে মৎস্য চাষের তথ্য রয়েছে। কোটি কোটি টাকা লাভ হয়েছে দাবি করা হলেও তানভীর ফিশারিজ কোন টাকাই ব্যাংকে লেনদেন করেননি। প্রতিষ্ঠানটির নামে খোলা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৭-০২-২০১৬ থেকে ০৩-০৬-২০১৮ সালের মধ্যে মাত্র ৮৮৪৬৭৭ টাকা লেনদেন হয়েছে। এভাবে পোল্ট্রি ও মৎস্য খামারের আড়ালে নোটগাইড বিক্রেতা আবু সাঈদ ৫৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার বেশী অবৈধ সম্পদ বৈধ করার চেষ্টা করেছেন। যা দূর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬(২), ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুদক সুত্র জানায় গত দেড় দশকে আবু সাঈদ অন্তত ৩শ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।
এ অর্থের উৎসের বৈধতা দিতে তিনি কৃষিভিত্তিক কাগুজে প্রতিষ্ঠান গড়ে তা থেকে আয় দেখাচ্ছেন তার বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ ও তথ্যপ্রমান সহ ২০১৭ সালে দুদকে অনুসন্ধানের জন্য পাঠায় জাতীয় রাজস্ববোর্ড (এনবিআর) কিন্ত দুদক তদন্তের নামে কাটিয়ে দিচ্ছে বছরের পর বছর। ৫ অর্ধদশকের দীর্ঘ অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় একের পর এক অনুসন্ধান কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন।
পূর্ববতী কর্মকর্তা মামলা রুজুর সুপারিশ করলেও পরবর্তী কর্মকর্তা দিয়েছেন দায়মুক্তির সুপারিশ। বর্তমানে চলছে তৃতীয় দফার অনুসন্ধান। জানাগেছে পর্যাপ্ত প্রমান হাতে থাকা সত্তেও সংস্থাটির ভেতর থাকা দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট তাকে
দায়মুক্তি দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। এ প্রক্রিয়ায় আবু সাঈদের সঙ্গে বানিজ্যিক সম্পর্কে জড়ানো দুদকের একজন উপপরিচালক
তাকে বিগত কমিশনে দায়মুক্তির সুপারিশ করেন। কিন্তু বর্তমান কমিশন প্রতিবেদনটির অনুমোদন না দিয়ে পুন:অনুসন্ধানের জন্য পরিচালক মো: ইউসুফের নেতৃত্বে একটি টিম করে দেন। উক্ত টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে পূর্ববর্তী কর্মকর্তার দেয়া প্রতিবেদনের ভয়াবহ গড়মিল খুজে পায়। তা সত্বেও মোটা অংকের নজরানার বিনিময়ে সংস্থাটির একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা
৫৭ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিয়োগ থেকে দায়মুক্তি প্রদানের চেষ্টা করেছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আবু সাঈদের টিএন্ডটি টেলিফোনে কল করা হয়। রিং হলেও ফোন রিসিভ হয়নি। পড়ে নোটগাইড বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে মো: কামরুল হাসান কাকন বলেন, স্যার মো: আবু সাঈদ এখন চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর আছেন। তবে আপনার বার্তাটি তাকে পৌছে দেব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের অনুসন্ধান টীমের পরিচালক মো: আবু ইউসুফ বলেন, গত জুনে আমরা সরেজমিন পরিদর্শনে
জাবুসা পরিদর্শন করেছি। এখনো প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি। কাজ চলছে। দায়মুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব
মো: মাহবুব হোসেন বলেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমান পেলে কমিশন নিশ্চই ব্যবস্থা নিবে। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যত প্রভাবশালীই হোন অর্থের বিনিময়ে দুদক থেকে তিনি পার পাবেন না।