মৌলিক সেবা, দুর্নীতি, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের দাবিতে জেনারেশন জেড বা ‘জেনজি’ প্রজন্মের তরুণদের বিক্ষোভ এখন আর আঞ্চলিক নয়—তা রীতিমতো বৈশ্বিক এক রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। এশিয়া থেকে শুরু হয়ে আফ্রিকা পর্যন্ত এই তরুণ তরঙ্গ শুধু শাসকদের কাঁপিয়ে দিচ্ছে না, কোথাও কোথাও সরকার পতনের ঘটনাও ঘটছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে মাদাগাসকারে পানি ও বিদ্যুৎ সংকট ঘিরে জেনজি নেতৃত্বাধীন আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। প্রাণ হারান অন্তত ২২ জন, আহত হন শতাধিক। পরিস্থিতির চাপে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। এটিই আফ্রিকায় জেনজি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রথম বড় রাজনৈতিক পদক্ষেপ। তবে এতে আন্দোলন থামেনি। এখনো রাজধানী আন্তানানারিভোসহ বিভিন্ন শহরে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় গোতাবায়া রাজাপাকসের পতনের মধ্য দিয়ে জেনজি আন্দোলনের সূচনা ঘটে। এরপর তা দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া হয়ে আফ্রিকা এবং ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এই তরুণদের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে—আর্থিক বৈষম্য, কর্মসংস্থানের সংকট, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি এবং জবাবদিহির অভাব।
সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য জেনজি আন্দোলনগুলো—
ফিলিপাইন: ‘ট্রিলিয়ন পেসো মার্চ’ নামে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে সোশ্যাল মিডিয়ায় সংগঠিত হয়ে রাস্তায় নামে লাখো তরুণ। চাপের মুখে সরকার নীতিগত পরিবর্তন আনে, গঠন করে তদন্ত কমিশন।
ভারত (লাদাখ): লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে তরুণরা রাজপথে। বিক্ষোভ সহিংস রূপ নিলে লেহ শহরে কারফিউ জারি করে ভারতীয় প্রশাসন। আন্দোলনের নেতৃত্বে ‘জেনজি’ প্রজন্ম।
নেপাল: সরকারি সেন্সরশিপ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ। তরুণরা প্রযুক্তিনির্ভর সংগঠনের মাধ্যমে পুরো কাঠমান্ডু অচল করে ফেলে।
ইন্দোনেশিয়া: ‘ডার্ক ইন্দোনেশিয়া’ আন্দোলনে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট কাটছাঁট এবং সামরিক আইনের সংস্কারের প্রতিবাদে রাস্তায় নামে তরুণরা। সরকার মন্ত্রিসভায় রদবদল আনে ও এমপিদের ভাতা বাতিল করে।
মরক্কো: ‘জেনজি ২১২’ আন্দোলনে তরুণদের দাবি—স্টেডিয়ামের বদলে হাসপাতাল। বিশ্বকাপ অবকাঠামোতে বরাদ্দ বাড়ানো নিয়ে ক্ষোভে উত্তাল দেশ। আন্দোলন এখনো চলছে।
বাংলাদেশ: ২০২৪ সালে জুনে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়। মূল দাবি ছিল—চাকরির নিয়োগে মেধার ভিত্তিকে প্রাধান্য দেয়া। কিন্তু সরকারি দমন-পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের মুখে এটি রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। অবশেষে গত বছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালান।
জর্জিয়া (ইউরোপ): ‘ফরেন এজেন্ট’ আইন পাসের বিরোধিতায় শিক্ষার্থীদের অবস্থান ধর্মঘট। আশঙ্কা—এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে।
কেনিয়া: ‘রিজেক্ট ফাইন্যান্স বিল’ আন্দোলনে নতুন করনীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে তরুণরা। আন্দোলনের চাপে সরকার অর্থবিল প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে এটি ক্ষণিকের প্রতিবাদ নয়, প্রজন্মগত জাগরণ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস বলছে, এই আন্দোলন সাময়িক প্রতিক্রিয়া নয়—বরং দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও বঞ্চনার ফল।
মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভেদি হাদিজ বলেন, “তরুণরা রাগান্বিত। তারা মনে করে, রাষ্ট্র তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে। পুরনো শাসনব্যবস্থা আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না।”
দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সামরিক ও করপোরেট দখলদারিত্ব—এই সব কিছু মিলেই তরুণদের রাজপথে নামতে বাধ্য করছে।
শুধু আন্দোলন নয়, রাজনৈতিক শক্তির পুনর্গঠন
বিশ্লেষকদের মতে, জেনজি আন্দোলন এখন আর বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবাদ নয়—এটি একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, যা রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির দাবি জানাচ্ছে।
তরুণদের বার্তা স্পষ্ট— “বৈষম্য ও অনিশ্চয়তার বোঝা আর বইব না।”
বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া এই তরুণদের জাগরণ ভবিষ্যতের রাজনীতিকে নতুন দিশা দেখাচ্ছে। পুরনো কাঠামোর ওপর আস্থা হারিয়ে, তারা নিজেরা হয়ে উঠছে পরিবর্তনের মুখ।