পটুয়াখালীর জুলাই শহীদ রায়হান (২১) হত্যা মামলায় পটুয়াখালীর মাদারবুনিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলহাজ্জ¦ আবু হানিফ এর নির্দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের আসামী করাসহ মামলায় হয়রানি ও অর্থ বানিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। ঢাকার বাড্ডা থানার মামলা নং-৩৫, ২৮/০৪/২০২৫।
এ ব্যাপারে একাধিক গোপন অডিও রেকর্ড এসেছে হাতে। যার সূত্র ধরে বেরিয়ে এসেছে বিএনপি নেতাসহ সাবেক ছাত্রদল নেতাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ। মামলা সূত্র এবং বাদীর বক্তব্যে জানা গেছে, গত ০৫ আগষ্ট ২০২৪ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের আগ মুহুর্তে ঢাকার মেরুল বাড্ডা এলাকায় ১.৪৫ মিনিটের সময় গুলিবিদ্ধ হয় পটুয়াখালীর সদর উপজেলার মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের চালিতাবুনিয়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক কামাল আকনের পুত্র সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারী বয় রায়হান আকন। সে সময় পথচারীরা তাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে। রায়হান গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ই দুসরা বিষয়টি তার বাবাকে জানায় এবং সন্ধ্যায় রায়হানের মৃত্যু হলে ঢাকায় অবস্থানরত স্বজনরা তার মরদেহ পটুয়াখালী এনে নিজ গ্রামে ০৬ আগষ্ট ২০২৪ দাফন করে। শহীদ আবু রায়হানের বাবা মামলার বাদী কামাল আকনকে প্রায়ই তার বাড়িতে গিয়ে শান্তনা দিত ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবু হানিফ এবং তার পুত্র পটুয়াখালী সদর উপজেলার ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ঢাকার চিফ ম্যাট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) এ্যাডভোকেট মশিউর রহমান। পিতা পুত্রের নিজেদের স্বার্থ হাসিল, মামলায় হয়রানি করে অর্থ বানিজ্যের ষড়যন্ত্রের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে কামাল আকনকে। পরিকল্পনা মাফিক বাদিকে প্রলোভন দেখিয়ে হত্যা কান্ডের প্রায় ৮ মাস পর গত ২০/০৪/২০২৫ তারিখে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট জসিতা ইসলাম এর (২১) নং কোর্টে জজ কোর্টের এ্যাডভোকেট আলমগীর সিদ্দিকীর মাধ্যমে স্মারক নং-৬৮৪, সিআর মামলা-১৮৬/২০২৫ আনয়ন করলে আদালতের নির্দেশে ৩০২/১০৯/৩৪ ধারায় মামলা রুজু করা হয়। বাড্ডা থানার মামলা নং-৩৫, ২৮/০৪/২০২৫।
মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী এবং অর্থ বানিজ্যের অভিযোগ এবং গোপন অডিও রেকর্ডের সূত্র ধরে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালায় । অনুসন্ধানে উক্ত মামলায় আবু হানিফ তার পুত্র এ্যাডভোকেট মশিউর রহমানের সাথে মামলায় সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলার হারুন খলিফার পুত্র কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা আমিনুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর দক্ষিন ছাত্রদলের সাবেক সদস্য সচিব নিয়াজ মাহমুদ নিলয় এবং পটুয়াখালীর লোহালিয়া ইউনিয়নের কুড়িপাইকা গ্রামের আব্দুল কাদের সিকদারের পুত্র ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সাবেক আহবায়ক এবং ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি) এর বর্তমান যুগ্ম আহবায়ক জসিম উদ্দিন রানা সিকদার এর নাম। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ ২৩৬ জনকে আসামী করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ১৫০ জন শিল্পপতি, ডাক্তার, সাংবাদিক, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ী রয়েছে। যাদেরকে ফ্যাসিস্টের তকমা লাগানো হয়েছে এদের বেশির ভাগই বিএনপি নেতা কর্মী। যার মধ্যে বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার প্রায় ২০ জন বিএনপি পরিবারের সদস্য এবং নেতাকর্মী রয়েছেন। অডিও রেকডিং এ মশিউর এবং জসীম উদ্দিন রানা সিকদারের কথোপকথনে কে কয়জন আসামী দিয়েছেন এবং কে কত টাকা আদায় করেছেন তা ফুটে উঠেছে। পটুয়াখালীর সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা মনির খান ১ লক্ষ টাকা দিয়েছেন জনৈক আসামীর নাম বাদ দেওয়ার জন্য, অন্য একজন ৪০ হাজার এবং অন্য একজন আরও ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন এবং রাঙ্গাবালী উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা সেলিম মল্লিক পটুয়াখালীর আরেক শ্রমিক লীগের সদস্য ফারুক হোসাইন চৌকিদারের সাথে প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা চুক্তি করে পটুয়াখালী পৌর বিএনপির সহ সভাপতি আলিম আকনকে মামলায় আসামী করার জন্য । এছাড়াও পটুয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য এ্যাড. ফিরোজ আলমের মাধ্যমে আসামী দেওয়ার কথা জানা গেছে। অডিও রেকডিং এ কেন্দ্রীয় বিএনপির জনৈক নেতার নাম উঠে এসেছে। তিনিও ১০ জন আসামীর নাম দিয়েছেন এবং ৮ জনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা গ্রহণ করেছেন। জানা গেছে পিএসসি প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য জসীম উদ্দিন রানা সিকদার একাই ১৭০ জন আসামীর নাম দিয়েছেন। যার মধ্যে ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও প্রকৌশলী রয়েছেন। যাদের সাথে তার ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে।
বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদারের শশুর বরিশাল মহানগর ২৪নং ওয়ার্ডের ০৬ বার নির্বাচিত কাউন্সিলর এবং মহানগর বিএনপির সাবেক সহ সভাপতি ফিরোজ আহম্মেদ আক্ষেপ করে বলেন , আমি একজন বিএনপির কট্টর নেতা, আমাকে আরও ১০ টি মামলায় দিলেও দু:খ থাকতো না, আমাকে কেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সাথে মামলা দেওয়া হলো। আমার এলাকায় একটি রাস্তার বিরোধ নিয়ে আমার প্রতিবেশী ঢাকা জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিকী হীরন অ্যাডভোকেট মশিউরের মাধ্যমে আমাকে মিথ্যা মামলার আসামী করেছেন।
দুমকি উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম মুন্সীর পুত্র ইমাম হোসেন শুভকে মামলায় আসামী করা হয়েছে, মশিউর এবং রানা সিকদারের মাধ্যমে তিনি জানান, কেন্দ্রীয় কমিটির ছাত্রদল নেতা আমিনুল ইসলাম ফোনে তাকে ঢাকায় অ্যাড. মশিউরের সাথে সাক্ষাত করতে বললে, তিনি গত ১৯ মে ২০২৫ সোমবার বেলা ২.০০ টায় ঢাকার রামপুরা হোটেল আল কাদরিয়ায় সাক্ষাত করলে আমার ছেলেকে মামলা থেকে বাদ দিয়ে দিবে মর্মে ১০ লক্ষ টাকা দাবী করে অ্যাড. মশিউর। তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের একজন নেতার মোবাইল নম্বর (০১৭১৮৯০১৩৪১) যোগাযোগ করতে বলে। পটুয়াখালী পৌর বিএনপির সহ সভাপতি আলিম আকন বলেন, আবু হানিফ মশিউর রানা গং টাকার বিনিময়ে আমাকে হয়রানী করার জন্য ফ্যাসিস্টদের সাথে মামলা দিয়েছে। আমি পটুয়াখালী জেলা বিএনপি নেতৃবৃন্দের কাছে দোষীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানাচ্ছি। মামলার ৫নং আসামী পটুয়াখালী কুয়াকাটা হোটেল ব্যবসায়ী খায়ের মোল্লা ঢাকা প্রতিদিনকে বলেন, জসীম উদ্দিন রানা সিকদার গত ১৮/০৯/২০২৪ তারিখে আমাকে পটুয়াখালী কোর্ট চত্তর থেকে অপহরণ করে। তার লোহালিয়া গ্রামের বাড়িতে একদিন আটকে রেখে অস্ত্রের মুখে আমার কুয়াকাটা হোটেল রোজ ভ্যালী লিখে নেয় এবং দখল করে। আমাকে পুনরায় হয়রানী করার জন্য মামলায় আসামী করেছে। আমি বিএনপির জাতীয় নেতৃবৃন্দসহ পটুয়াখালী জেলার নেতৃবৃন্দের কাছে সুষ্ঠু সমাধান এবং বিচার দাবী করছি। মামলার বাদী কামাল আকন বলেন, এ্যাড মশিউর আমার ছেলের এককালীন অনুদান মুক্তিযোদ্ধাদের মত গেজেট এবং মাসে মাসে ভাতা প্রাপ্তির জন্য আবেদন করে ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে দাড়াতে হবে বলে ঢাকায় যাওয়ার জন্য ফোন করে। আমি ঢাকা যাই এবং ঢাকা ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে দাড়াই। পরবর্তীতে ০২ মাস পর জানতে পারি আমাকে দিয়ে ২৩৬ জনের বিরদ্ধে মিথ্যা মামলা করানো হয়েছে। আমি মশিউরের এ প্রতারণার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করছি এবং দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দাবী করছি।
মামলা সর্ম্পকে মাদারবুনিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলহাজ্জ আবু হানিফ বলেন, আমি এর সাথে জড়িত নই। তবে আমার ছেলে বাদীকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাবেক নেতা জসীম উদ্দিন রানা সিকদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এ্যাড মশিউর রহমান বলেন, আমি সরাসরি মামলার সাথে সম্পৃক্ত নই। আমি আপনার সাথে দেখা করবো বলে সংবাদটি না প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ করেন। জসীম উদ্দিন রানা সিকদারের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ না করার কারণে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মামলায় পটুয়াখালী বিএনপি নেতাকর্মীদের আসামী দেওয়া প্রসঙ্গে পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক পটুয়াখালীর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) বিজ্ঞ আইনজীবী মজিবুর রহমান টোটন বলেন, আমি এ বিষয়ে জেনেছি এবং জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে আলোচনা করেছি এবং আইন শৃঙ্খলা মিটিং এ উত্থপান করেছি। বাদী নিজেও জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করেছেন। তারা এ বিষয়ে উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিবেন। একজন এপিপি হয়ে মামলায় মিথ্যা আসামী দেওয়া একটি গর্হিত কাজ। এর সাথে বিএনপির নেতা জড়িত থাকলে লিখিত অভিযোগ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পৌর বিএনপির সাধারন সম্পাদক পটুয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব আইনজীবী হুমায়ুন কবির বলেন, আলিম আকনসহ যাদেরকে এই মামলায় আসামী করা হয়েছে তা আদো সঠিক হয়নি। আলিম আকন দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে আমাদের সাথে ছিলেন তিনি একজন বিএনপির নিবেদীত প্রাণ নেতা।
মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, মামলা রেকর্ডের ক্ষেত্রে কোন অসংগতি থেকে থাকতে পারে। বাদীরও ভুল হতে পারে বা অভিযোগকারী বা বিভিন্ন মানুষের দ্বারা হতে পারে। এই ক্ষেত্রে পুঙ্খানু পুঙ্খানুভাবে তদন্ত করে যারা প্রকৃতভাবে দোষী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে এবং চার্জশীটের আওতায় আসবে। যারা দোষী না, যারা আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন না এবং কোনো নির্দোষ লোক আইনের আওতায় আসবেনা।