অডিটর পদটি ১১ গ্রেড থেকে দশম গ্রেডে উন্নীতের জন্য কর্মবিরতি দিয়ে দেড় মাস ধরে আন্দোলন করছেন অডিটররা। তাদের টানা এই আন্দোলনের ফলে সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এ নিয়ে সচিবালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে চলছে বিভিন্ন আলোচনা। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ ৪৩টি মন্ত্রণালয়, বিদেশে অবস্থানরত মিশন, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাব, আদালত ও সরকারি কর্মচারীদের হিসাব অডিট করেন অডিটররা। এর পরই মূলত বেতন ছাড় করে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে প্রায় দেড় মাস ধরে আন্দোলন এবং কর্মবিরতিতে থাকায় এসব হিসাবের কাজ করছেন না অডিটররা। সরকারি কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন,
বেতন-ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিপাকে পড়তে পারে সরকার।
জানা যায়, তৃতীয় শ্রেণির আওতাভুক্ত অডিটর পদটি ১১তম গ্রেড। আদালতের রায়ে দশম গ্রেডের সব সুবিধা পেলেও মন্ত্রণালয় কর্তৃক অডিটর পদটি দশম গ্রেডে চান তারা। এ দাবিতে দেড় মাস ধরে কর্মবিরতিতে থেকে আন্দোলন করেছেন তারা। অর্থ মন্ত্রণালয় ও আইন উপদেষ্টা তাদের দাবির পক্ষে সম্মতি দিলেও কোনো ‘অদৃশ্য শক্তির’ কারণে দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারীরা। তারা বলছেন, অডিট ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা দশম গ্রেডের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখছেন। এমনকি নিজেদের দায় এড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয় একেক সময় একেক ধরনের চিঠি পাঠাচ্ছে।
সিএজি কার্যালয় থেকে অডিটর পদকে ১১তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেডে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে (স্মারক নং-৫৬৫) গত ১২ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে তার এক দিন পর অডিটর পদের বেতন গ্রেড দশম করা যাবে কি না, সে বিষয়ে মতামত চেয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। দশম গ্রেডে উন্নীতকরণের জন্য আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বাস্তবায়নের পক্ষে সম্মতিসহ মতামত দেন।
সিএজি ক্যাডার কর্মকর্তাদের অধীনে অডিট কর্মকর্তাদের নিয়োগ পরীক্ষা হয়। অডিটরদের দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে তাদের চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা চলে যাবে পিএসসির কাছে। যদিও অডিটর নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে প্রায়ই নানা অভিযোগ উঠে আসে।
অডিটররা বলছেন, পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ পরীক্ষা শুরু হলে অডিট ক্যাডারদের নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে অডিট কর্মকর্তাদের ওপর ক্যাডার কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব কমে যাবে এবং অডিট রিপোর্ট পরির্বতন করার সুযোগ হাতছাড়া হবে। অডিটরদের পোস্ট আপগ্রেডেশন ঝুলে থাকার এটি একটি কারণ। অডিটরদের ১০ম গ্রেড বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে ৩৬ থেকে ৪১তম ক্যাডাররা জড়িত। এর মধ্যে সিএজি বরাবর অডিটর দশম গ্রেড বন্ধের স্মারকলিপি, অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক বিবৃতি, ক্যাডার কমকর্তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাদা ছোড়াছুড়ি, আন্দোলনের মঞ্চ-প্যান্ডেল ভেঙে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
অডিটর পদকে ১১তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেডে উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য এবং আইন মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক মতামত উপেক্ষা করে অর্থ মন্ত্রণালয় পরপর দুদিনে দুই ধরনের পত্র জারি আদালত অবমাননার শামিল বলে মনে করেন অডিটররা। কালবেলাকে তারা বলেছেন, মন্ত্রণালয় ও আদালত নির্দেশনা দিলেও এসব বিষয় জেনেও তারা চুপ। এই চুপ থাকার কারণ হচ্ছে, কোনো সিন্ডিকেটের ক্ষমতার কাছে তারা জিম্মি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে না। এ মুহূর্তে সবার উচিত বর্তমান সরকারকে সহযোগিতা করা; কিন্তু তা না করে মন্ত্রণালয় ও আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে কৌশলে সিএজিসহ সব অফিসে একটি অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। আইন উপদেষ্টা দশম গ্রেড বাস্তবায়নের পক্ষে সম্মতি দিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর পেছনে ক্যাডার কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্র আছে বলে আমরা মনে করি।
অডিটরদের আন্দোলনের মুখপত্র আহমেদুর রহমান ডালিম বলেন, দশম গ্রেড আমাদের দাবি নয়, অধিকার। এই অধিকারের পক্ষে আদালতেরও রায় রয়েছে। একই পদে চাকরি করে কেউ বেতন পায় দশম গ্রেডে। আর আমরা পাই ১১তম গ্রেডে, যা চরম বৈষম্য। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অডিটরের পদকে ১১তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেডে উন্নীতকরণের নির্দেশনা প্রদান করা হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর ওই রিট মামলার পক্ষভুক্ত ৬১ জন অডিটরের পদকে ১১তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেডে উন্নীত করে। এতে দেশের ৬ হাজার ৯২৪ জন অডিটর একই পদে দুই গ্রেডের বৈষম্যের শিকার হবেন। বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের অধীন সব অডিট অধিদপ্তর, সিজিএ, সিজিডিএফ এবং এডিজি ফাইন্যান্সের অডিটররা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমাদের দশম গ্রেডে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সিএজি কার্যালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি আমাদের অডিট ডিপার্টমেন্টের
নন-ক্যাডারদের যেসব দাবি রয়েছে যেমন জুনিয়র অডিটর, অডিটর, সুপার এবং অ্যাকাউন্ট অফিসারদের গ্রেডের পুনর্বিন্যাসে মতামত প্রদান ও সুপারিশ করে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ সচিবের সম্মতিক্রমে সেই সুপারিশ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। একটি অদৃশ্য শক্তি সেই সুপারিশ বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আজ পর্যন্ত সেই সুপারিশ কার্যকর হয়নি। এরপর আমরা আদালতে যাই। আদালত অডিটর পদের আপগ্রেডেশনের পক্ষে রায় দেন। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের রায়ের অপব্যাখ্যা করে মাত্র ৬১ জনের বেতন-ভাতা দশম গ্রেডে উন্নীত করে। প্রকৃতপক্ষে আমরা বেতন-ভাতার আপগ্রেডেশন চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম আমাদের পদের আপগ্রেডেশন। বৈষম্য দূর করার জন্য আমরা নিয়মতান্ত্রিক আবেদন করেছি। আইনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই আমরা আদালতের রায়ের বাস্তবায়ন চাই। পোস্ট পজিশনের আপগ্রেডেশন হলেই আমরা কাজে ফিরে যাব।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদারের কার্যালয়ে গেলে তিনি দেখা করেননি। পরে তাকে একাধিকবার ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
ডেপুটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) সিনিয়র এসএম রিজভী বলেন, ক্যাডার কর্মকর্তারা দশম গ্রেড বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, এমন তথ্য আমার জানা নেই। আইনগতভাবে যা হবে, সেটাই করা হবে।