ঢাকা-১৭ আসন উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন মোহাম্মদ এ আরাফাত। নৌকা প্রতীকে লড়ে ভোট পেয়েছেন ২৮ হাজার ৮১৬টি। যা মোট ভোটের মাত্র ৯ শতাংশ। আর মোট ভোট পড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। ভোটের আলোচনা ও পরিসংখ্যান বলছে, মোহাম্মদ এ আরাফাত নৌকা প্রতীকে লড়ে আওয়ামী লীগের ভোটও সব নিজের দখলে নিতে পারেননি।
গত ১৭ জুলাই (সোমবার) সকাল থেকে ভোট কেন্দ্রগুলো ভোটারের অপেক্ষায় ছিল। কোনো কেন্দ্রেই ভোটার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল না। কেন্দ্র কিংবা বুথের সামনে ভোটারদের লাইন দেখা যায়নি। দিনভর ভোটারের অপেক্ষায় অনেকটা অলস সময় পার করতে হয়েছে কেন্দ্র সংশ্লিষ্টদের। দিনশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে জয় লাভ করেন আরাফাত।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন। উপনির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে ৩৭ হাজার ৫২০টি। এর মধ্যে বাতিল হয়েছে ৩৮৩ ভোট। অর্থাৎ মোট ভোট পড়েছে ১১.৫১ শতাংশ।
আরাফাতের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ২৮ হাজার ৮১৬। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী একতারা প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম (হিরো আলম) পেয়েছেন ৫ হাজার ৬০৯ ভোট। ২৩ হাজার ২০৭ ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন নৌকা প্রার্থী।
প্রশ্ন উঠেছে, ভোটারের এমন উপস্থিতি কি শুধুই উপনির্বাচনের কারণে? নাকি আওয়ামী লীগেরও অনেকে ভোট দিতে আসেননি?
ঢাকা-১৭ আসনে থানা রয়েছে চারটি। গুলশান, বনানী, ভাষানটেক ও ক্যান্টনমেন্ট থানা। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আওয়ামী লীগের থানা কমিটিতে পদ রয়েছে ৭১টি। চার থানায় পদ থাকার কথা ২৮৪টি।
সংসদীয় আসনটিতে ওয়ার্ড রয়েছে চারটি। ওয়ার্ড নং ১৫, ১৮, ১৯ ও ২০নং ওয়ার্ড। আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটিতে পদ রয়েছে ৬৯ সদস্যের। চার ওয়ার্ডে পদ থাকার কথা ২৭৬টি।
প্রতিটি ওয়ার্ডে পাঁচটি করে ইউনিট ধরলেও ২০টি ইউনিট থাকার কথা ঢাকা-১৭ আসনে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের ইউনিট কমিটিতে পদ রয়েছে ৩৭টি করে। সে হিসেবে ২০টি ইউনিটে ৭৪০টি পদ রয়েছে।
অর্থাৎ ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগের মূল দলের পদ রয়েছে অন্তত ১৩০০টি। প্রতিটি পদের বিপরীতে দুইজন করে ধরলেও প্রায় তিন হাজার নেতা রয়েছে শুধু মূল দলের। আবার তাদের কর্মীরাও আছেন।
আসনটিতে যুবলীগের থানা কমিটি নেই। কমিটি না থাকলেও রয়েছে পদপ্রত্যাশী। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, যুবলীগের থানা কমিটি ৩১ সদস্যের এবং ওয়ার্ড কমিটি ২১ সদস্যের।
সে হিসেবে চার থানায় যুবলীগের পদ প্রত্যাশী ১২৪ জন এবং চার থানায় ৮৪ জন। ২০টি ইউনিটে আরও অন্তত ১২০০টি পদ রয়েছে।
কমিটি না থাকলে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই পদ প্রত্যাশীর সংখ্যা থাকে বেশি। সে হিসেবে আসনটিতে যুবলীগের নেতাকর্মীর সংখ্যাই তিন হাজারের বেশি।
স্থানীয়দের ভাষ্য, মূল দল ও যুবলীগের তুলনায় ঢাকা-১৭ আসনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর সংখ্যা অনেক বেশি। চার থানা, এর অন্তর্গত ওয়ার্ড ও ইউনিট মিলে যা সংখ্যায় ১০ হাজারের কম নয় বলে জানা গেছে।
তিন থেকে পাঁচ হাজার করে কর্মী আছেন আসনটির স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষকলীগ, তাঁতী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, যুব মহিলা, মহিলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের কমিটিতে।
সে হিসেবে ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন ভাতৃপ্রতীম ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত ৩৫-৪০ হাজার সক্রিয় নেতাকর্মী থাকার কথা।
এদিকে এবার ভোট কম পড়লেও এর আগে আসনটির অন্যান্য নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল না।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনের ভোটের ফল ভিন্ন তথ্যই দিচ্ছে। ওই নির্বাচনে আসনটিতে নৌকার প্রার্থী ছিলেন আকবর হোসেন পাঠান ওরফে নায়ক ফারুক।
নির্বাচনে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৯৯৮ ভোটের বিপরীতে তিনি পেয়েছিলেন ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬১০। আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী আন্দালিব রহমান পেয়েছিলেন ৩৮ হাজার ৬৩৯ ভোট।
দশম সংসদ নির্বাচনে এস এম আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) থেকে আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিন ভোট পেয়েছিলেন ৪৩ হাজার ৫৮৫। এম এ হান্নান মৃধা স্বতন্ত্র প্রার্থী পেয়েছিলেন ৪ হাজার ৪৬ ভোট।
নবম সংসদ নির্বাচনে হুসাইন মু. এরশাদ জাতীয় পার্টি (জাপা) এ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ১ লাখ ২৪ হাজার ১২৮ ভোট পেয়ে। বিএনপির এ এস এম হান্নান শাহ পেয়েছিলেন ৫৬ হাজার ২৮৬ ভোট।
বিগত কয়েকটি উপ-নির্বাচনের তুলনায় ঢাকা-১৭ আসন উপ-নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ভালোই ছিল। কয়েক বছর আগে ঢাকা-৫ আসনে উপ-নির্বাচন হয়েছিল। ভোট পড়েছিল ৫ শতাংশ। ঢাকা-১০ উপ-নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫ শতাংশ। কয়েক বছর আগে ঢাকা-১৮ আসনে অনেক ঢাক-ঢোল পিটানোর পরেও ভোট পড়েছিল ১৪ শতাংশ। সেখানে ঢাকা-১৭ একটা টার্মলেস ইলেকশন। এখানে প্রায় ১২ পারসেন্ট ভোট পড়েছে, এটা অনেক। আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে যদি এই নির্বাচনটা হইতো, তাহলে দুই পারসেন্ট ভোট পড়ত।
—শেখ বজলুর রহমান, সভাপতি , ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ
অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম ২ লাখ ২১ হাজার ৪৪০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ. কে. এম. রহমতউল্লাহ আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হয়ে পেয়েছিলেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৩২ ভোট।
সপ্তম সংসদে আসনটির সংসদ সদস্য ছিলেন এ. কে. এম. রহমতউল্লাহ। আওয়ামী লীগের এই প্রার্থী ভোটের মাঠে এক লাখ ৩২ হাজার ৪৪৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। বিএনপির মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম পেয়েছিলেন ১ লাখ ৯ হাজার ৩৭০ ভোট।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান মনে করেন, বিগত কয়েকটি উপ-নির্বাচনের তুলনায় ঢাকা-১৭ আসন উপ-নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ভালোই ছিল।
তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে ঢাকা-৫ আসনে উপ-নির্বাচন হয়েছিল। ভোট পড়েছিল ৫ শতাংশ। ঢাকা-১০ উপ-নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫ শতাংশ। কয়েক বছর আগে ঢাকা-১৮ আসনে অনেক ঢাক-ঢোল পিটানোর পরেও ভোট পড়েছিল ১৪ শতাংশ। সেখানে ঢাকা-১৭ একটা টার্মলেস ইলেকশন। এখানে প্রায় ১২ পারসেন্ট ভোট পড়েছে, এটা অনেক। আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে যদি এই নির্বাচনটা হইতো, তাহলে দুই পারসেন্ট ভোট পড়ত।
ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচনে ভোটারের চেয়ে সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশি দেখা গেছে। কেন্দ্রের বাইরে অনেক মানুষ দেখা গেছে যারা এই আসনের বাইরের লোক। এরা এখানকার ভোটারই নয়। কারও পক্ষে শোডাউন করতে এসেছেন। তবে একজনের ভোট অন্যজন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একজনের ভোট অন্যজন দেবে এটা প্রত্যাশিত নয়। এত জল গড়ানোর পর এখনও কেন ভোটার নিজের ভোট দিতে পারবে না।
—ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, চেয়ারম্যান, জানিপপ
তিনি দাবি করেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অনেক পরিশ্রম করেছেন। আর ভোট কম হওয়ার কারণ জানিয়ে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের এই সভাপতি বলেন, নৌকার অনেক ভোটার আর এখন এই এলাকায় বসবাস করেন না। তারা তো স্থায়ী না। অনেক ভোটার অন্য এলাকায় চলে গেছেন।
অবশ্য উপনির্বাচনে স্বাভাবিকভাবে ভোটার উপস্থিতি কম থাকে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম নিয়ে জানিপপের চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচনে ভোটারের চেয়ে সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশি দেখা গেছে। কেন্দ্রের বাইরে অনেক মানুষ দেখা গেছে যারা এই আসনের বাইরের লোক। এরা এখানকার ভোটারই নয়। কারও পক্ষে শোডাউন করতে এসেছেন। তবে একজনের ভোট অন্যজন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একজনের ভোট অন্যজন দেবে এটা প্রত্যাশিত নয়। এত জল গড়ানোর পর এখনও কেন ভোটার নিজের ভোট দিতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, উপনির্বাচনে সবসময় ভোটারদের উৎসাহ কম থাকে। সেই নির্বাচনের মেয়াদে আরও কম হলে উৎসাহে ভাটা পরে। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন যদি অবস্থা বিরাজ করে তাহলে তো আরও আগ্রহ হারায় মানুষ। ভোটারটা মনে করেছে কেন্দ্রে গিয়ে লাভ কি। ভোট দিলেও জিতবে, আর না দিলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিতবে।