ঢাকা: অবশেষে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য লেনদেন শুরু হলো রুপিতে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে রুপিতে লেনদেনের এই যাত্রা উদ্বোধন করা হয়। বলা হচ্ছে, মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে এই লেনদেন। পরবর্তীতে এই সুবিধা টাকাতেও মিলবে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই বাণিজ্য নীতিতে অনেক কিছুই অস্পষ্ট। লাভ বা সুযোগ-সুবিধার বিষয় পরিষ্কার করা হয়নি। তাই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কি আমাদের লাভ হচ্ছে তা এখনই পরিষ্কার বলা যাচ্ছে না। কিছুদিন লেনদেন চললে সেটা বোঝা যাবে।
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ও বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (আইসিআইসিআই) ব্যাংক রুপিতে বাণিজ্য লেনদেনের নিষ্পত্তিতে অংশ নিচ্ছে।
জানা গেছে, রুপিতে লেনদেনের প্রক্রিয়া চালু করতে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনে ভারতের ব্যাংকগুলোতে রুপিতে ‘নস্ট্র অ্যাকাউন্ট’ খুলেছে সোনালী ও ইবিএল। ‘নস্ট্র অ্যাকাউন্ট’ হলো বিদেশের কোনো ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রায় লেনদেন করতে খোলা হিসাব। এর ফলে ডলারের মাধ্যমে এলসি বা ঋণপত্র খোলার প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি রুপিতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য ভারতের ব্যাংক দুটিতে ঋণপত্র খুলতে পারবেন দেশটির আমদানিকারকরা। একইভাবে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যাংক দুটিতে ঋণপত্র খুলতে পারবেন আমদানিকারকরা। বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য ভারতে রপ্তানি করবে, তার বিপরীতে প্রাপ্ত রপ্তানি আয়ের সমপরিমাণ অর্থের পণ্য আমদানি করা যাবে রুপিতে। টাকার বিপরীতে রুপিতে বিনিময় হার ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ হার ধরে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি খরচ নির্ধারণ করবে ব্যাংকগুলো।Rupi1প্রথম দিন ২.৮ কোটি রুপি লেনদেনের মধ্য দিয়ে আমদানি-রপ্তানি শুরু হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রথম রুপিতে রপ্তানি চালান পাঠিয়েছে বগুড়ার তামিম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। রপ্তানি চালানের মূল্য ছিল ১.৬ কোটি রুপি। এই আমদানির ঋণপত্র খোলে ভারতের আইসিআইসিআই ব্যাংক। আর রপ্তানিকারকের
ব্যাংক ছিল স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (এসবিআই) বাংলাদেশ শাখা।
এছাড়া রুপিতে দেশের প্রথম আমদানি করেছে নিটল-নিলয় গ্রুপ। আমদানি চালানের মূল্য ১.২ কোটি রুপি। আমদানির ঋণপত্র খোলে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (এসবিআই) বাংলাদেশ শাখা।
রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি শুরুর বিষয়টিকে একটি ‘বড় সূচনার প্রথম পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ঝুড়িতে থাকা ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনবে রুপির লেনদেন। বড় কোনো যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ এটি। সামনের দিকে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে আরও বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে আজকের এই উদ্যোগ।
ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, রুপিতে আমদানি-রপ্তানি শুরু হওয়ায় দুই দেশের বন্ধুত্ব ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন হলো। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভারতের পঞ্চম বাণিজ্যিক অংশীদার।Rupiতবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রুপিতে লেনদেন শুরু হলেও অনেক কিছুই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। কারণ বাংলাদেশ যে পরিমাণ রপ্তানি করে তারচেয়ে অনেক বেশি আমদানি করে থাকে। তাই আমদানির অতিরিক্ত রুপি কিভাবে সমন্বয় করা হবে সেটা আরও পরিষ্কার করা দরকার।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বলা হচ্ছে রুপিতে লেনদেনে লাভ যেটা হবে তা হচ্ছে ডলারের উপর চাপ কিছুটা কমবে। কারণ আমরা ভারত থেকে যা ইমপোর্ট করি, তার সব পেমেন্টই ডলারে করতে হয়। ডলারের উপর প্রেসারটা কম হলে রেটটা কিছু স্থিতিশীল হতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে যে বিষয়টা পরিষ্কার না সেটা হলো আমাদের রপ্তানি ভারতে যে মাত্রায় হয় তারচেয়ে অনেক বেশি আমরা আমদানি করি। কাজেই যে ব্যালেন্স থাকবে সেটা কিভাবে পেমেন্ট করা হবে? কেউ কেউ বলছে ভারত থেকে ঋণ নেওয়া হবে। কিন্তু ঋণ নিলে সেটার আবার সুদের হার কেমন হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তারপরও আমার মনে হয় এটা কিছুদিন ট্রায়াল করতে দেওয়া উচিত। তবেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
রুপিতে লেনদেনের জন্য আলাদা করে রুপি কিনতে পারবে না বাংলাদেশের ব্যাংক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (এসবিআই) কান্ট্রি ম্যানেজার অমিত কুমার জানান, পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংক যে রুপি আয় করবে, তাই দিয়ে কেবল আমদানির দায় পরিশোধ করা যাবে। এই সীমা ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) ঠিক করে দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পণ্য বুঝে নেওয়ার পর ভারতীয় ব্যাংকে থাকা এ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের হিসাবে রুপিতে জমা হয়ে যাবে পণ্যমূল্য। আর সেই রুপি দিয়ে ভারতের উদ্যোক্তাদের কাছে বাংলাদেশের আমদানি দায় মেটাতে হবে। ভারতে থাকা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকে রপ্তানির আয় যোগ হওয়ার পর স্থানীয় রপ্তানিকারককে টাকায় পণ্যমূল্য পরিশোধ করবে বাংলাদেশের ব্যাংক। এটি হবে বাংলাদেশের আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) লেনদেন ব্যবস্থার মাধ্যমে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রুপিতে লেনদেনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক যে দিকটা রয়েছে সেটা এখনও শুরু হয় নাই। রুপি কার্ড ইস্যু করা হবে। যারা ভারতে ভ্রমণ করবে তাদের আগে যেমন টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হতো, আবার ডলার দিয়ে রুপি কিনতে হতো, এখন সরাসরি ওই কার্ডের মাধ্যমে টাকা দিয়ে রুপি কেনা যাবে। ওইদিক থেকে একটা সুবিধা হচ্ছে। ভ্রমণকারীদের জন্য পেমেন্ট করা সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু ওটাতো বড় কোনো ইস্যু না। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আসলে কি সুবিধা হবে তা আমার কাছে পরিষ্কার না।Rupiতিনি আরও বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত বুঝতে পারছি যে এটা একটা বিকল্প পেমেন্ট পদ্ধতি। আগে এটা ছিল না। আগে ডলারে পেমেন্ট করতে হতো। এখন আমরা যে পরিমাণ এক্সপোর্ট করি ভারতে, তার মধ্যে থাকলে রুপিতে এলসি খুলতে পারবেন কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনাকে ইবিএল বা সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে। অন্য ব্যাংকে তো আর করা যাবে না। আবার আপনি যদি রপ্তানিকারক হন আপনি আগে ডলারে পেমেন্ট নিতেন। এখন আপনি চাইলে রুপিতে পেমেন্ট নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনি চাইবেন কি না সেটা ভিন্ন বিষয়। যদি চান তবে রুপিতে পেমেন্ট নিয়ে এটা সরাসরি টাকায় কনভার্ট করতে পা
রবেন। এতে বিশাল কি সুবিধা হবে সেটা পরিষ্কার না। কারণ আগে আমি ডলারকে যেমন টাকায় কনভার্ট করতাম, এখন আমার আমদানি করতে রুপির দরকার হচ্ছে।
তিনি বলেন, রুপি তো আমাকে ডলার দিয়েই কিনতে হচ্ছে। কাজে আমার তো ডলার লাগছেই। বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন তো আর কমে যাচ্ছে না। কাজেই যে দাবিটা করা হচ্ছে যে এর ফলে ডলারের চাহিদা কমবে এবং আমাদের সংকট নিরসনে সেটা সহায়ক হবে, সেটা কিভাবে হবে তা পরিষ্কার না। কারণ ডলারের জায়গায় রুপি লাগবে আমার। কিন্তু আমার কাছে তো রুপি নাই। আছে টাকা। এক বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমিয়ে আরেক বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বাড়বে। সামষ্টিক বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা তো আর কমছে না। অনেক কিছুই এখনও অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
এদিকে রুপিতে লেনদেন চালু হওয়ার পর পাঁচ মাসের মধ্যে টাকা ও রুপিতে লেনদেনযোগ্য ডেবিট কার্ড চালুর ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বাংলাদেশের নিজস্ব এ ডেবিট কার্ডে নাম হবে ‘টাকা পে কার্ড’। এ কার্ড ব্যবহার করে ডুয়েল কারেন্সি সুবিধায় ভারতীয় রুপি ও টাকায় লেনদেন করতে পারবেন একজন গ্রাহক। গভর্নর জানান, আগামী সেপ্টেম্বরেই কার্ডটি চালু করা যাবে বলে তারা আশা করছেন। তবে রুপিতে লেনদেন করতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগবে, সেজন্য আরও কিছুদিন সময় লাগতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। যা চীনের পর সর্বোচ্চ (মোট আমদানি ব্যয়ের ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ)। এর বিপরীতে ভারতে রপ্তানি করা হয়েছে মাত্র ১৯৯ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য।