মিডিয়াতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা শুনি নিয়মিত। মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্টের কথা শুনলে তাদের আত্মত্যাগের কথা শুনে অনেকে কাঁদেন। ইতিহাস চর্চা আমরা করতে পারি। এর প্রয়োজনও রয়েছে। কিন্তু অবস্থা এমন হচ্ছে বর্তমান যেন হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের উদোরে। ৫১ বছরের স্বাধীন দেশের কি অবস্থা সেটি কি আমরা ভেবে দেখেছি? চারদিকে লুটপাট। সরকারি চাকরি পেয়েই অনেকে হয়ে উঠছেন সম্পদের কুমির। ৭ মে ২০২৩ দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল- ‘কর্মকর্তার স্ত্রীর নামেই ৯১ গাড়ি’।
উপশিরোনাম ছিল- নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে ভুয়া বিলের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়াত্ত কারখানাটির ৩৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন সহকারী প্রধান হিসাবরক্ষক মুহম্মদ ইকবাল।
এই রিপোর্ট থেকে প্রথম কয়েকটি বাক্য এখানে তুলে ধরছি- এইচএসসি পাস করে ২০০৫ সালে বিসিআইসির প্রকল্প, শাহজালাল সারকারখানায় সহকারী হিসাবরক্ষক পদে চাকরি নিয়েছিলেন। এরপর ১৪ বছরের চাকরি জীবনে তিনি সর্বশেষ ওই কারখানার সহকারী প্রধান হিসাবরক্ষক ছিলেন। এই সময়ে ৯১টি গাড়ি, ঢাকায় একাধিক ফ্লাট, দু’টি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
আমরা এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালকের শত শত কোটি টাকার সম্পদের কথা মিডিয়াতে শুনেছি। বক্ষব্যাধি হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠার গল্প শুনেছিলাম। স্বল্প আয়ের কোনো লোক যদি বিলিয়ন ডলারের মালিকও হন তাতে অসুবিধা নেই। সেটা বৈধ পথে হোক। ধরা যাক সরকারি কোনো অফিসের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হঠাৎ সমুদ্রে মূল্যবান সম্পদ পেলেন। তার বাড়ির মাটির নিচে মূল্যবান ডায়মন্ড পেলেন। অথবা তার পরিবারের কোনো সদস্য বৈধভাবে ব্যবসায় করে বিপুল সম্পদের মালিক হতে পারেন।
যেমন কোনো সরকারি তৃতীয় শ্রেণীর কমর্চারীর পরিবারের কোনো সদস্য এমন কোনো পণ্য বের করলেন যেটি বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেল। বৈধ পথে উপার্জনের আরো অনেক কিছু হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারি কর্মচারীদের যে সম্পদ আছে তা কি সেরকম কোনো বৈধ উপায়ে হয়েছে? শুধু সরকারি কর্মচারীরা নন, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরও অনেকের সম্পদ হয়ে উঠেছে পাহাড় পরিমাণ! চারদিকে ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি। ইউপি মেম্বার, ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, সিটি মেয়র, এমপি-মন্ত্রী এদের বেশির ভাগই সম্পদের পাহাড়ের মালিক হয়ে উঠেছেন।
সরকারি চাকরি পেতেও ঘুষ দিতে হয় মোটা অঙ্কের। রাজনৈতিক লবিং- সেটিও লাগে। সিটি করপোরেশনের অফিসগুলোতে আমরা কর্মচারীদের প্রকাশ্য ঘুষ নিতে দেখি। রাজউক অফিস, থানায় প্রকাশ্যে চলে। বিআরটিএর অফিসে তো ঘুষের মেলা বসে! এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মচারীর ঢাকায় একেক জনের ডজন ডজন ফ্ল্যাট-প্লট রয়েছে। মফস্বল এলাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের কেউ কেউ এমপি-মন্ত্রী হয়েই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠছেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে। স্বাধীন দেশে এত বৈষম্য কিভাবে তৈরি হলো? এক দিকে কয়েক কোটি নাগরিক চরম দারিদ্র্যতার মধে আরেক দিকে কয়েক লাখ লোক সম্পদের পাহাড়ের মালিক হয়েছেন।
এটি কোনো বানানো গল্প নয়। আমাদের চারদিকের বাস্তবতায় তা দেখছি। কবে কিভাবে এই বৈষম্য দূর হবে আমরা জানি না। কিভাবে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ হবে সেটিও জানি না। তবে আশা করি, এক সময় ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে।