ঢাকা : মঙ্গলবার বাজারের এই ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে কাজ করেছে বিএসইসির একটি আদেশ। তালিকাভুক্ত কোম্পানির অবণ্টিত লভ্যাংশ দিয়ে গঠন করা পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের আদেশ দেয়া হয়। এর পরই শেয়ারগুলো হারিয়ে ফেলা দর ফিরে পেতে থাকে, সেই সঙ্গে সূচকে যোগ হয় পয়েন্ট।
আগের দিনের ১৮২ পয়েন্ট পতনের ধারাবাহিকতায় লেনদেন শুরুর এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই সূচক থেকে হাওয়া ১৩৭ পয়েন্ট। মুহূর্তেই আতঙ্ক আরও জেঁকে বসে।
কিন্তু এরপর নিয়ন্ত্রক সংস্থার এক আদেশে মুহূর্তেই দেখা দেয় উল্টো চিত্র। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আগের দিনের চেয়ে ১৭ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন শেষ হয়।
এমন কোনো উত্থান নয়, তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেখা দেয়া ধসের মধ্যে এটিই এক বড় স্বস্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলবার বাজারের এই ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে কাজ করেছে বিএসইসির একটি আদেশ। তালিকাভুক্ত কোম্পানির অবণ্টিত লভ্যাংশ দিয়ে গঠন করা পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের আদেশ দেয়া হয়। এর পরই শেয়ারগুলো হারিয়ে ফেলা দর ফিরে পেতে থাকে, সেই সঙ্গে সূচকে যোগ হয় পয়েন্ট।
আগের দিন ৩৬৪টি কোম্পানির শেয়ার দর হারিয়েছিল। এর মধ্যে ৫ শতাংশের বেশি দর হারায় ৯০টি কোম্পানি, ৬৭টির দর কমে ৪ শতাংশের বেশি। এর বিপরীতে বেড়েছিল কেবল ১০টি কোম্পানির শেয়ারদর, যার মধ্যে দুটির বেড়েছিল এক শতাংশের কম।
প্রায় একই রকম পরিস্থিতি থেকে পরের দিন ঘুরে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ২১৭টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ে। বিপরীতে কমে ১১৬টির দর। ৪৫টি কোম্পানি দর ধরে রাখতে পারে।
লেনদেন আগের দিনের তুলনায় কিছুটা বেশি হলেও এখনও গতি ফেরেনি। দিন শেষে হাতবদল হয়েছে ৭৪৬ কোটি ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকার শেয়ার, যা আগের দিন ছিল ৭৪০ কোটি ২৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।
এ নিয়ে টানা ৮ কর্মদিবস এক হাজার কোটি টাকার কম শেয়ার হাতবদল হলো।
বিএসইসির আদেশে বড় পতন থেকে ঘুরল পুঁজিবাজার
মঙ্গলবার সূচকে ১৭ পয়েন্ট যোগ হওয়াটাও বিনিয়োগকারীদের স্বস্তি দেবে এ কারণে যে আগের দিন ১৮২ পয়েন্টের পর এদিনও এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই ১৩৭ পয়েন্ট সূচক কমে যায়
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে দেশে পুঁজিবাজারে পতনের মধ্যে বাংলাদেশে যে ধস দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত কেবল ৮ কর্মদিবসে সূচক কমে ৩৮২ পয়েন্ট বা ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
এই টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ২০১০ সালের মহাধসের স্মৃতি যে ফিরেছে, সেটি পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক নানা ফেসবুক পেজে ঢুঁ দিলেই বোঝা যায়।
সোমবার দরপতনের মধ্যেই বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম একটি বার্তা পাঠান বিনিয়োগকারীদের জন্য। তিনি আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘সবার প্রতি আমার অনুরোধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের তেমন সম্পর্ক নেই। অযথা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করবেন না।’
তিনি বলেন, ‘গত কয়েক দিনে আমরা বিএসইসির পক্ষ থেকে বাজার মনিটর করে দেখেছি, বড় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করছেন না। ছোট বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন; আর সেই বিক্রির চাপেই বাজারে প্রভাব পড়েছে।’
এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত গেছেন বিএসইসি প্রধান। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, পুঁজিবাজারে সাপোর্ট দিতে আরও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন তিনি। সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
বাজার বিশ্লেষক ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ সাদেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যুদ্ধ আতঙ্কে বাজার অনেক পড়ে গিয়েছিল। ভালো-মন্দ সব শেয়ারের দামই অনেক কমে গিয়েছিল। এখন বাজার বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি, যুদ্ধের প্রভাব বাজারে পড়েছে ঠিক। কিন্তু এর বাইরে কোনো কারসাজি করে বাজার অস্থিতিশীল করা হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে বিএসইসিকে। যদি অন্য কোনো কারণে বাজারে অব্যাহত পতন হয়, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা দিতে হবে।’
সূচক বাড়াতে প্রধান ভূমিকায় যেসব কোম্পানি
সূচক যতটা বেড়েছে, তার অর্ধেকই যোগ করেছে লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট। বহুজাতিক কোম্পানিটির শেয়ারদর ৪.৫২ শতাংশ বাড়ায় সূচকে যোগ হয়েছে ৮.৬৮ পয়েন্ট।
রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি তিতাস গ্যাসের শেয়ার দরে যোগ হয়েছে ৪.৩৯ পয়েন্ট, কোম্পানিটি সূচকে যোগ করেছে ৪.৪৯ পয়েন্ট।
বেক্সিমকো ফার্মা ৩.৪৫, পাওয়ারগ্রিড ৩.৪২, বেক্সিমকো লিমিটেড ৩.০৪, রবি ২.৮, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট ২.৫২, জিপিএইচ ইস্পাত ২.৪৫, ওরিয়ন ফার্মা ১.৮৭ এবং স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক সূচকে যোগ করেছে ১.৮৪ পয়েন্ট।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানিই সূচকে যোগ করেছে ৩৫ পয়েন্ট।
বিপরীতে রেনাটার শেয়ারের ২.৩৮ শতাংশ দরপতনের কারণে সূচক পড়েছে ৯.০৪ পয়েন্ট। এই কোম্পানিটিই সূচক সবচেয়ে বেশি নিচের দিকে টেনে নামিয়েছে।
বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকোর শেয়ারদর ক্রমেই কমছে। পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ালেও এই কোম্পানিটি আরও ১.০৬ শতাংশ দর হারিয়েছে। দিন শেষে শেয়ারদর দাঁড়িয়েছে ৫৬৭ টাকা ২০ পয়সা, যা কিছুদিন আগেও ছিল সাত শ টাকার কাছাকাছি। এই দরপতনের কারণে সূচক কমেছে ৮.৯৪ পয়েন্ট।
ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারদর ৪.৭১ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ৮,৯২ পয়েন্ট।
বার্জার পেইন্টস, স্কয়ার ফার্মা, গ্রামীণফোন, ওয়ালটন, সোনালী পেপার, রেকিট বেনকিনজার ও মেঘনা পেট্রলিয়াম ছিল সবচেয়ে বেশি সূচক কমানো কোম্পানির তালিকায়।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানির কারণে সূচক কমেছে ৪৫.০৯ পয়েন্ট।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি ৯.৮৪ শতাংশ দর বেড়েছে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিডি থাইফুডের। শেয়ারদর আগের দিন ছিল ৩৯ টাকা ৬০ পয়সা, সেটি এখন দাঁড়িয়েছে ৪৩ টাকা ৫০ পয়সা।
দ্বিতীয় স্থানে ছিল জীবন বিমা খাতের সানলাইফ লাইফ ইন্স্যুরেন্স, যার দর ৯.৭৭ শতাংশ বেড়েছে ৩৫ টাকা ৮০ পয়সা থেকে হয়েছে ৩৯ টাকা ৩০ পয়সা।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিডিকমের দর ৯.৬৫ শতাংশ, বস্ত্র খাতের এনভয় টেক্সটাইলের দর ৯.৬৩ শতাংশ, তথ্যপ্রযুক্তির আরেক কোম্পানি ইনটেকের দর ৯.৩২ শতাংশ বেড়েছে।
এছাড়া সাধারণ বিমা খাতের বিজিআইসির দর ৮.৪২ শতাংশ, আর্থিক খাতের বিআইএফসির দর ৮.৩৩ শতাংশ, বস্ত্র খাতের কুইনসাউথ টেক্সটাইলের দর ৮.২৯ শতাংশ, ওষুধ ও রসায়ন খাতেন ইমাম বাটনের দর ৬.৫৩ শতাংশ এবং লাভেলো আইসক্রিমের দর ৬.২৩ শতাংশ বেড়েছে।
আরও ৫টি কোম্পানির শেয়ারদর ৫ শতাংশের বেশি, ১২টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ৩৫টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ৩৯টির দর বেড়েছে ২ শতাংশের বেশি।
দরপতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে ছিল রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির শেয়ার ৬.২১ শতাংশ কমে ৭৫ টাকা ৬০ পয়সা থেকে হয়েছে ৭০ টাকা ৯০ পয়সা।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আর্থিক খাতের কোম্পানি বিডি ফাইন্যান্স ৫.৭৩ শতাংশ দর হারিয়েছে। আগের দিন শেয়ারের দর ছিল ৪৩ টাকা ৬০ পয়সা। সেটি এখন দাঁড়িয়েছে ৪১ টাকা ১০ পয়সা।
এছাড়া প্রগতি ইন্স্যুরেন্স ৪.৭৩ শতাংশ, আরামিট সিমেন্ট ৪.৫৭ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংক ৪.৫১ শতাংশ, সাধারণ বিমা খাতের বিএনআইসিএল ৩.৫৮ শতাংশ, একই খাতের ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স ৩.৩১ শতাংশ, সোনালী পেপার ৩.০৯ শতাংশ ও বার্জার পেইন্টস ২.৯০ শতাংশ দর হারিয়েছে।