বাংলাদেশি রোগীদের জন্য চীনে চিকিৎসা : সম্ভাবনা ও বাস্তবতা

স্কাই নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

উন্নত প্রযুক্তি ও বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি রোগীদের প্রধান গন্তব্য ছিল ভারত। হৃদরোগ, ক্যানসার, কিডনি রোগসহ নানা জটিল রোগের চিকিৎসায় কম খরচ ও সহজ যাতায়াতের কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ভারতে চিকিৎসা নিতে যেতেন। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশিদের ভিসা দিতে তালবাহানা শুরু করে ভারত। গুরুতর অসুস্থতার প্রমাণ দিয়েও অনেকে ভিসা পাচ্ছেন না। এতে করে বাংলাদেশিদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়। ফলশ্রুতিতে দিল্লির বিকল্প গন্তব্য খুঁজতে শুরু করেন রোগীরা। আর এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য চীনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অনুরোধে চীনের কুনমিং প্রদেশে স্বল্প খরচে জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসা নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশিরা।

প্রতিনিধি দলের চীন সফর ও অভিজ্ঞতা

গেল ১০ মার্চ চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে বাংলাদেশ থেকে ৩১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল কুনমিং যায়। ওই দলে ছিলেন ১৪ জন রোগী, তাদের পরিবারের সদস্য, চিকিৎসক, ট্রাভেল এজেন্সির প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমকর্মীরাও। দলে ছিলেন বাংলাদেশের গুণী সংগীতশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার হায়দার হোসেন। তিনি চীনে গিয়ে হার্ট এবং কাঁধের চিকিৎসা করান।

সেখানকার চিকিৎসার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এক বাক্যে বলতে গেলে তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ‘অসাধারণ’। আমি চীনে দুইটি সমস্যা নিয়ে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলাম। প্রথমটি হার্ট এবং দ্বিতীয় হচ্ছে কাঁধের সমস্যা। তারা আমার হার্টের একটি পরীক্ষা করেই সমস্যা নির্ধারণ করেন, আর কাঁধের জন্য কোনো ওষুধ না দিয়ে বেশ কিছু ব্যায়াম দিয়েছেন। আলহামদুল্লিলাহ এখন ভালো আছি।

চিকিৎসা খরচ সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ খরচ হয়েছে। তবে দেশটিতে ভাষাগত সমস্যা রয়েছে। দোভাষী ছাড়া কোনো বাংলাদেশি গেলে নিজেদের সমস্যার কথা বুঝাতে ঝামেলায় পড়তে পারেন।

চীনে চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে

ভারতের ভিসা জটিলতার কারণে অনেক বাংলাদেশি রোগী এখন চীনের দিকে ঝুঁকছেন। ২০২৪ সালের শুরুতে ভারতের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে যান ৫৫ বছর বয়সী শাহেদ আলী। তার চিকিৎসা শেষ হওয়ার আগেই ৫ আগস্ট দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। হাসিনা সরকারের বিদায়ের পরপর ভারত ভিসা দেয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য শাহেদ আলী আর ভারত যেতে পারেননি। এখন এ রোগের চিকিৎসার জন্য তিনি চীনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

৩১ সদস্যের বাংলাদেশের ওই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ছিলেন একটি বেসরকারি টেলিভিশনে কর্মরত সংবাদকর্মী নাঈম আবির। বাংলাদেশি রোগীরা কি ভারতের পরিবর্তে চীনে যেতে আগ্রহী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশি রোগীদের জন্য চীনের কুনমিং ভারতের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। ভারতের সঙ্গে যেহেতু বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে, এ সুযোগ কাজে লাগাতে চাচ্ছে চীন। বেশ কয়েকটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বেসরকারি বড় বড় ব্যয়বহুল যেসব হাসপাতাল রয়েছে, তার তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কম খরচে চীনে উন্নত চিকিৎসা সেবা নেয়া সম্ভব।

এছাড়া তাদের সব সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এতে করে প্রতেকটি হাসপাতালের সব ডাটা দেশটির সরকারের কাছে থাকে। আর এ জন্য রোগী সমান সুবিধা পাবে বলে আশা করা যায়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ভারতে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা গ্রহণে ভ্যাট এবং ট্যাক্স দিতে হয়, কিন্তু চীনে বাংলাদেশি রোগীদের তা দেয়ার প্রয়োজন হবে না। চীনের সাধারণ নাগরিকদের যে খরচ হয় বাংলাদিশের ক্ষেত্রে সেই খরচই হবে।

চিকিৎসা খরচ ও মান

চিকিৎসা খরচ ও মান সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্র্যাক মেডি সার্ভিস ও টার্কিশ হেলথকেয়ার ট্রাভেল কাউন্সিলের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. রাশেদুল হাসান বলেন, চীনের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভারতের তুলনায় অনেক কম খরচে উন্নতমানের চিকিৎসা সম্ভব। হার্টের চিকিৎসায় কুনমিংয়ের ফু-আই ইউনান হাসপাতাল বিশেষভাবে দক্ষ। ২০২৪ সালে হাসপাতালটি ২০টি সফল হার্ট প্রতিস্থাপন করেছে। এছাড়া চীনের ক্যানসার চিকিৎসাও উন্নতমানের। কারণ শুধু যন্ত্রপাতি থাকলেই হয় না, সেগুলো চালানোর দক্ষতা থাকা জরুরি, যা চীনের চিকিৎসকদের রয়েছে।

চীন কিভাবে কম খরচে চিকিৎসা দিচ্ছে?

ভারতের প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী পাঠানোর জন্য হসপিটাল ট্যুরিজম কোম্পানিগুলো ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পায়, যা রোগীর ওপর খরচ বাড়িয়ে দেয়। চীনে এমন কোনো মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় খরচ অনেকটাই কমবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

চ্যালেঞ্জ ও জটিলতা

তবে চীনে চিকিৎসার কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে বলে মনে করেন ডা. রাশেদুল হাসান। দেশটিতে মেডিকেল রিপোর্ট কেবল চীনা ভাষায় তৈরি হয়, যা অন্য চিকিৎসকদের জন্য বোঝা কঠিন। এছাড়া কোনো ব্যক্তি চীনে চিকিৎসা সেবা নিতে গেলে তাদের নূন্যতম ১০ হাজার ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় ১২ লাখ টাকা ব্যাংক একাউন্টে দেখাতে হবে। বিষয়টি অনেক সাধারণ রোগীর জন্য কষ্টসাধ্য। অথচ ভারতের ক্ষেত্রে ২০০ ডলার, থাইল্যান্ডে দেড় লাখ ও ‍তুরস্কে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা থাকলেই ভিসা আবেদন করা যায়।

এসব সমস্যা দূর করার পাশপাশি ঢাকায় চীনা দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছে চীন সফর করা দলটি। এগুলোর মধ্যে চীনের ভিসা ফি কমিয়ে আনা, ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে ভিসা ইস্যু করা, চীনের বিমানবন্দরে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বাংলাভাষী হেল্প ডেস্ক রাখা। মেডিকেল রিপোর্ট চীনা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতে দেয়া এবং কোনো রোগী চীনে মারা গেলে মরদেহ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সে দেশের তত্ত্বাবধানে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা। এছাড়া চীনের হাসপাতালগুলো যেন রোগীদের আন্তর্জাতিক হেলথ ইন্সুরেন্স গ্রহণ করে সেই ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

চীনে চিকিৎসা পেতে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও এর খরচ, সেবা ও চিকিৎসার মান বিবেচনায় এটি বাংলাদেশের রোগীদের জন্য ভারতের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। ভবিষ্যতে যৌথ উদ্যোগ ও সহযোগিতা বাড়ালে এটি আরও সহজ ও উপযোগী হয়ে উঠবে।

এই পোস্ট টি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2021 Skynews24.net
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com