ঢাকা: করোনার সময়ে রাজধানীর গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় হওয়া মামলায় এজাহারের চার আসামিকে বাদ দিয়ে পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা পড়েছে।
আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত শেষে গত ২২ আগস্ট আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় পিবিআই। এতে এজাহারে উল্লেখ করা আসামি হাসপাতালটির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), সিইও এবং পরিচালককে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
আর ইউনাইটেড হাসপাতালের ছয় কর্মীকে অভিযুক্ত করেছে পিবিআই। তারা হলেন, হাসপাতালের মানবসম্পদ বিভাগের সুপারভাইজার খাদেমুল ইসলাম, দাউদ আলী, এসি টেকনিশিয়ান আনোয়ার হোসেন, তার সহকারী ফারুক হাওলাদার, লিমন মিয়া এবং আমিনুল ইসলামকে।
করোনা মহামারীর সময়ে ২০২০ সালের ২৭ মে ইউনাইটেড হাসপাতালের মূল ভবনের বাইরে আইসোলেশন ইউনিটে আগুন লেগে লাইফ সাপোর্টে থাকা পাঁচ রোগীর মৃত্যু হয়।
আগুনে প্রাণ হারানো রোগীরা হলেন— মো. মাহবুব, মনির হোসেন, ভারুন এ্যান্থনী পল, খাদেজা বেগম ও রিয়াজউল আলম। তারা সবাই করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালটির অস্থায়ী আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি ছিলেন।
পাঁচ রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় ওই বছরের ৩ জুন নিহত একজনের স্বজন রোনাল্ড মিকি গোমেজ ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যানসহ ছয়জনকে আসামি করে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলাটি প্রথমে গুলশান থানা-পুলিশ তদন্ত করে। গুলশান থানার পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ৩০ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দেন। তবে বাদীর আপত্তির কারণে আদালত পিবিআইকে মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেয়।
২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তকাজ শুরু করে পিবিআই। আর তদন্ত শেষে পিবিআই চলতি বছরের ২২ আগস্ট আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়। পিবিআই যাদের অভিযুক্ত করেছে থানা পুলিশের তদন্তেও তাদের নাম ছিল।
পিবিআই বলছে, যাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে আগুনের ঘটনায় তাদের গাফলতি ছিল না। সেই অনুযায়ী মামলার প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। ইউনাইটেড হাসপাতালের কর্মচারিরা কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অনিরাপদ আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তুলেছিলেন। যা পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে।
তবে পিবিআইয়ের তদন্তে এজাহারনামীয় আসামিদের বাদ দেওয়ায় তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে তারা হাসপাতাল থেকে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা নেন। চেয়ারম্যান, এমডি, সিইও এবং পরিচালকের নির্দেশনায় হাসপাতালটি পরিচালিত হয়ে আসছে। ফলে তাদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
মামলার নথি থেকে জানা গেছে, দগ্ধ রোগীদের কোনো ধরনের উদ্ধারের ব্যবস্থা গ্রহণ না করে চরম গাফিলতি, অবহেলা, দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, অগ্নিকাণ্ডের সময় চিকিৎসাধীন রোগীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি হাসপাতালের চিকিৎসক/সেবিকা এবং নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা রোগীদের প্রতি চরম অবিচার করেছেন। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর হচ্ছে ইউনাইটেড হাসপাতালের ওই আইসোলেশন ইউনিটের কোনো অনুমোদন ছিল না।
পিবিআইয়ের তদন্তে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই অনিরাপদ আইসোলেশন সেন্টার তৈরি করেছিল হাসপাতালের কর্মচারিরা। সেখানে অনিরাপদভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তাদের দায়িত্বহীনতা ও গাফলতির কারণে রোগীদের মৃত্যু হয়। তাই ছয় কর্মচারিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি যা পেয়েছি সেটাই দিয়েছি। আর আমাদের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা সব সময় তদন্ত মনিটরিং করেন। এখানে তদন্ত ভিন্ন দিকে নেওয়ার সুযোগ নেই।’
অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, মামলায় যে ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে যথাযথভাবে না জানিয়ে নিরাপত্তাহীনভাবে আইসোলেশন সেন্টার তৈরি করেন। অবহেলামূলকভাবে করোনা রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
অগ্নিকাণ্ডের সময় তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে জরুরি কোনো প্রকার পদক্ষেপ নেননি। অগ্নিকাণ্ড থেকে রোগীদের রক্ষা করতে দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতির পরিচয় দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত হত্যা এবং হত্যায় সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা মজিবুর রহমান বলেন, ‘এজাহারনামীয় সকলের নাম দেওয়া হয়নি। তদন্তে ওইভাবে তাদের সংশ্লিষ্টতা আসেনি। আমরা যে ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ-গাফিলতি পেয়েছি তাদের নামে প্রতিবেদন দিয়েছি।
ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যান-এমডির বিরুদ্ধে কী কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি? জবাবে পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘এজাহারে তাদের পদবি ছিল নাম ছিল না। যারা ওই আইসোলেশন সেন্টারের দায়িত্বে ছিলেন মূলত তাদের নাম এসেছে।
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, সেসময় হাসপাতালটির উচ্চ পর্যায়ের সবাই ছুটিতে ছিলেন। আর কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ওপর দায়িত্ব দেয়া ছিল। কার কি দায়িত্ব হবে সেটা বন্টন করে দেওয়া ছিল।
অভিযোগপত্র থেকে যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে তারা তো হাসপাতাল থেকে সবধরণের সুবিধা নিতেন। এতে ঘটনার দায় তো তারা এড়াতে পারেন না। জানতে চাইলে পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সুবিধাভোগী হলেই যে তারা ইয়ে করবে…। এসব বিষয়ে উচ্চআদালতে অনেক কিছু হয়েছে।
এদিকে ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুনে পাঁচ রোগীর মৃত্যুর পর উচ্চ আদালত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ৩০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে বলেন।