ঢাকা: ভারতের পর এবার চাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী আরেক রাষ্ট্র মিয়ানমার। অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল রফতানিতে সাময়িক লাগাম টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। এর ফলে বিশ্বে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে দেশের বাজারেও।
শুক্রবার (২৫ আগস্ট) মিয়ানমারের রাইস ফেডারেশনের এক জ্যেষ্ঠ সদস্য বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, চলতি মাসের শেষ থেকে ৪৫ দিনের জন্য চাল রফতানি সাময়িকভাবে সীমিত করবেন তারা।
মিয়ানমার বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম চাল রফতানিকারক দেশ। প্রতি বছর ২০ লাখ টনের বেশি চাল রফতানি করে থাকে বলে জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয়।
এর আগে গত মাসে বাসমতি নয় এমন চাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ ভারত। তাদের এই সিদ্ধান্তে বিশ্ববাজারে চাল সরবরাহ কমেছে এক কোটি টন বা ২০ শতাংশ। মিয়ানমার চাল রফতানি বন্ধ করে দিলে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও প্রকট হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মিয়ানমারের এই পরিকল্পনা প্রসঙ্গে মুম্বাইভিত্তিক একজন রফতানিকারক রয়টার্সকে বলেন, ‘মিয়ানমার বৈশ্বিক চালের বাজারে ভারত অথবা থাইল্যান্ডের মতো বড় খেলোয়াড় নয়। কিন্তু মিয়ানমার এমন এক সময় এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যখন বিশ্ববাজারে চালের সরবরাহ কমে গেছে। দেশটির এই পদক্ষেপে বৈশ্বিক চালের বাজারে অস্থিরতা বাড়বে। এতে ক্রেতাদেরও উদ্বেগ বাড়বে।’
ভারত রফতানি স্থগিতের পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চালের দাম। চাল রফতানিকারক দেশ হিসেবে এই দুই দেশ যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম। রয়টার্স জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে উভয় দেশের চালের দাম প্রতি টনে ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে।
ভিয়েতনামের চালের (৫ শতাংশ ভাঙা) দাম বেড়ে প্রতি টন দাঁড়িয়েছে ৬৫০ থেকে ৬৬০ ডলারে। থাইল্যান্ডেও এ মানের চালের দাম বেড়ে প্রতি টন ৬৩০ ডলার হয়েছে, যেখানে আগের সপ্তাহে এই দাম ছিল ৬১৫-৬২০ ডলার।
এল নিনোর প্রভাবে উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়ার মতো আমদানিকারক দেশ চালের সংগ্রহে নানা দিকে ছুটছে। তাতে বাজারে আরও অস্থিরতার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিবিসির খবরে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী কয়েক হাজার জাতের চাল উৎপাদন হয়। তবে আমদানি-রফতানি হয় মূলত চার জাতের চাল। এরমধ্যে সরু লম্বা দানার ইন্ডিকা চাল সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয়। আর বাকিগুলো হলো সুগন্ধি বাসমতি, ছোট দানার জাপোনিকা; যেটি সুসি এবং রিসোটস তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এবং আঠালো চাল; যা মিস্টি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রফতানিকারক দেশ হলো ভারত। বিশ্বের মোট চাহিদার ৪০ ভাগই আসে এই দেশ থেকে। চাল রফতানির শীর্ষে থাকা অন্য দেশগুলো হলো থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র।
চাল আমদানিকারক দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে চীন, ফিলিপাইন এবং নাইজেরিয়া। অপরদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারে ঘাটতি দেখা দিলে ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশ চাল আমদানি করে। এখন আফ্রিকা মহাদেশেও চালের চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া কিউবা এবং পানামাতেও শক্তির মূল উৎস হলো চাল।
গত বছর ভারত ১৪০টি দেশে ২২ মিলিয়ন টন চাল রফতানি করেছে। যার মধ্যে ছয় মিলিয়ন টন ছিল তুলনামূলক কমদামি ইন্ডিকা চাল। (গত বছর বিশ্বব্যাপী চাল আমদানি-রফতানি হয়েছে প্রায় ৫৬ মিলিয়ন টন)।
২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী যত চাল আমদানি-রফতানি হয়েছে তার ৭০ শতাংশ ছিল ইন্ডিকা চাল, আর এখন ভারত সেই চাল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। গত বছর দেশটি খুদের চাল এবং বাসমতি চাল রফতানির ওপর ২০ শতাংশ কর আরোপ করে। এরপরই এলো পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা।
প্রত্যাশিতভাবেই জুলাইয়ে ভারতের চাল রফতানি নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করে। আইএমএফের অর্থনীতিবিদ পিয়ে-অলিভার গোরিনচাস বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা চালের দাম বাড়িয়ে দেবে এবং বিশ্বব্যাপী শস্যের দাম ১৫ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাজার বিশ্লেষক সিরলে মুস্তাফা বলেছেন, ভারত এমন সময় চালের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যখন ‘সময়টা ভালো নয়।’ প্রথমত ২০২২ সালের শুরু থেকেই চালের দাম বাড়ছে। গত জুন থেকে এখন পর্যন্ত যা ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, চালের সরবরাহে এখন বিঘ্ন দেখা যাচ্ছে, বাজারে নতুন চাল আসতে আরও তিন মাস বাকি আছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় অস্বাভাবিক আবহাওয়া— ভারতে অধিক বৃষ্টি ও পাকিস্তানে বন্যা চাল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। এছাড়া সারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে চালের মূল্যও বেড়েছে। অপরদিকে যেসব দেশ চাল আমদানি করে তাদের মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় আমদানি বেড়ে গেছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে এ ব্যবসার ব্যয়ও বেড়েছে।